অভিমত
সংলাপে কী হয়
আলোচনা কিংবা সংলাপে বাংলাদেশের বড় কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়েছে—এমন কোনো নজির আমাদের সামনে নেই। বরং সংলাপ অনেক সময়ই ‘সং সেজে আলাপে’ পরিণত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি যে অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা—সেখানে সংলাপ করে কোনো কিছুর সুরাহা করা কঠিন। গণতন্ত্রে পরমতসিহষ্ণুতাই প্রধান বিষয় হলেও আমাদের রাজনীতিবিদরা এই ইস্যুতে বড়ই কৃপণ। ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় থাকাই যেখানে রাজনীতির শেষ কথা, সেখানে রাষ্ট্র ও জনগণ তাদের কাছে অনেক সময়ই গৌণ।
তারপরও আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসি যে ধারাবাহিক সংলাপ করেছে, তাকে অনেকেই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চান। যদিও বিএনপির সঙ্গে সংলাপে সিইসি কে এম নুরুল হুদার স্বাগত বক্তব্য শেষ মুহূর্তে সংলাপে নতুন মাত্রা দিয়েছে এবং নিজেকে ‘অধিকতর নিরপেক্ষ’ প্রমাণ করতে গিয়ে বা বিএনপিকে খুশি করতে গিয়ে বোধ হয় সিইসি মহোদয় একটু বেকায়দায়ই পড়েছেন।
১৫ অক্টোবর বিএনপির সাথে সংলাপের স্বাগত বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা’ বলে উল্লেখ করেন। এর পরের দিন ইসির সংলাপ ছিল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গে। এদিন সংলাপে অংশ নিয়ে দলের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী সিইসির ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন এবং সংলাপ বর্জন করেন। যদিও এই বর্জনের ঘোষণার আগে ইসির কাছে নির্বাচন নিয়ে ১৮ দফা সুপারিশ তুলে ধরে কাদের সিদ্দিকীর দল। সুতরাং সংলাপে অংশ নিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার পরে বয়কটের ঘোষণা কী তাৎপর্য বহন করে তা একটা প্রশ্ন।
এর দুদিন পরে ১৮ অক্টোবর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপ করে নির্বাচন কমিশন। এদিন স্বাগত বক্তব্যে সিইসি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিয়েছে।’ দেখা যাচ্ছে, সিইসি তার বক্তব্যে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। এটি অনেকটা বাড়িতে অতিথি এলে তার পোশাকের প্রশংসা করার মতো। কিন্তু একটি সাংবিধানিক পদে থেকে এ রকম উচ্ছ্বসিত প্রশংসার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সে প্রশ্ন তোলাই যায়। কেননা এখন বিএনপিও যদি আওয়ামী লীগকে নিয়ে করা সিইসির ওই বক্তব্যের সমালোচনা শুরু করে, তাতে আখেরে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তবে আশার কথা, জিয়াউর রহমানকে নিয়ে করা তার বক্তব্যের বিষয়ে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সংলাপ শেষে বেরিয়ে তিনি বলেন,‘জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলে সিইসি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন,আমরা তার ব্যাখ্যা পেয়েছি। এ নিয়ে কিছু বলতে চাই না। ব্যাখ্যা দিতে হলে নির্বাচন কমিশন দেবে।’
দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের সাতটি করণীয় বিষয় নির্ধারণ করে একটি কর্মপরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছিল। এগুলো হচ্ছে :
১. আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার।
২. নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ গ্রহণ।
৩. সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ।
৪. নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ।
৫. বিধি-বিধান অনুসরণপূর্বক ভোটকেন্দ্র স্থাপন।
৬. নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা।
৭. সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ।
এর বাইরে নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা, নারী নেতা এবং নির্বাচন পরিচালনা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপের সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। নভেম্বর মাসে এসব সংলাপ থেকে পাওয়া সুপারিশের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করে ডিসেম্বর মাসেই সুপারিশ চূড়ান্ত করার কথাও জানানো হয়।
রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে সংলাপে ইসি যেসব প্রস্তাব ও পরামর্শ পেয়েছে, তার অনেকগুলোর বাস্তবায়নই তাদের এখতিয়ারে নেই। যেমন নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদ ভেঙে দিয়ে ভোটের আয়োজন ইত্যাদি। আবার নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে যেগুলো রয়েছে, তারও কতগুলো তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে, তা এখনই বলা মুশকিল।
যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই আলোচনা বা সংলাপের ইতিহাস খুব সুখকর নয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়েও জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারাঙ্কোর সাথে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। কিন্তু তার পরিণতি কী হয়েছে, তা দেশের মানুষ জানে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নানাবিধ আলোচনার পরও রাজপথে কী ভীষণ রক্তারক্তি হয়েছিল, তা দেশের মানুষের ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রক্রিয়া যখন চলছিল, তখন নানা বিষয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনা করেছিল সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি। কিন্তু ওইসব সংলাপে বিশিষ্ট নাগরিকরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে যেসব মতামত বা সুপারিশ দিয়েছেন, বলা যায় তার কিছুই গ্রহণ করেনি কমিটি। বিশেষ করে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, আদিবাসী,তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ৭০ অনুচ্ছেদ, বিচারপতিদের অভিশংসন ইত্যাদি ইস্যুতে। ফলে নির্বাচন কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলের এই সংলাপ আখেরে কী ফল দেবে তা মোটামুটি চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়।
তারপরও আমরা আশাবাদী হতে চাই। নির্বাচন কমিশন একটা সদিচ্ছা থেকেই এই সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে বলেই দেশের মানুষ মনে করে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বড় সদিচ্ছা প্রয়োজন সরকারের। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে কি না- এসব বিষয়ের বাইরে সবচয়ে বড় প্রশ্ন এই যে, নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে তার দায়িত্বটুকু পালন করতে পারবে কি না? যদি পারে তাহলে নির্বাচনকালীন কথিত সহায়ক বা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও প্রয়োজন নেই। তবে নির্বাচন কমিশন আসলেই কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারবে, তার পুরোটাই নির্ভর করবে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।