রোহিঙ্গা সংকট
বহুমুখী সমস্যার শেষ কোথায়?
জাতিসংঘের অতিসম্প্রতি দেওয়া একটি বিবৃতি পড়ে আমি বেশ বিব্রত বোধ করেছি। তার কারণ একটু পরে বলছি। আগে আসুন, জাতিসংঘ কী বলেছে, তা দেখি। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের তিনটি প্রতিনিধিদলের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সৌভাগ্য বলছি, কারণ মিয়ানমার দয়া করে তাদের সেখানে যেতে দিয়েছে। এই তিনটি দলের প্রথম দলটি ছিল বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের। তার মধ্যে ছিলেন বিবিসির সাংবাদিক জোনাথান হেড। তাঁর মাধ্যমে আমরা রাখাইনে ঘটে যাওয়া বর্বরতার ক্ষুদ্র একটি চিত্র পাই। সামরিক বাহিনীর পাহারায় থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি দিতেও পারতেন না।
দ্বিতীয় দলটি ছিল কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের। সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। গত সপ্তাহে এ সফর হয়। তাঁরাও বলেছেন, রাখাইনে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ উগ্রপন্থীরা নৃশংসতা চালিয়েছে। সে চিত্র তাঁরা পেয়েছেন এবং বিশ্বকে বলেছেন।
সর্বশেষ দলটি রাখাইনে গেছে জাতিসংঘের হয়ে। ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’-এ দলটি ফিরে গিয়ে জাতিসংঘে যা বলেছে, তা নিয়েই আমার পুলক জেগেছে। তাঁরা এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, ২৫ আগস্ট ‘আরসা’র হামলার পর যে সামরিক অভিযানের কথা মিয়ানমার বলছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বাস্তবে রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে তারও কয়েক সপ্তাহ আগে। তখন সেখানে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয় এবং রোহিঙ্গাদের বাছাই করে করে আটক করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা-নির্যাতনও শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতেই ২৪ আগস্ট আসে এবং ‘আরসা’ আরাকান স্যালভেশন আর্মি, বুঝে হোক না বুঝে হোক প্রতিরোধযুদ্ধ শুরুর নামে কয়েক জায়গায় হামলা করে বা বলা যায় সামরিক বাহিনীর সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করে। তখন সেখানে ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়, যাতে ১০-১২ জনের মতো সেনা ও পুলিশ সদস্য মারা যায়। আর প্রতিরোধকারী আরসা সদস্য ও রোহিঙ্গা মারা যায় কয়েকশ’। মিয়ানমার সরকারের ভাষায় যা তিন শতাধিক। অতএব, জাতিসংঘ দলটির ভাষায়, মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যা বা জাতিগত নিধনের বিষয়টি সে দেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর পূর্বপরিকল্পিত একটি অভিযান। ২৫ আগস্ট যা তারা পুরোদমে বাস্তবায়ন শুরু করে এবং অদ্যাবধি সে অভিযান চলছে।
আমার পুলকিত হওয়ার কারণ হলো, জাতিসংঘের এই বক্তব্য হুবহু মিলে গেছে আরাকান স্যালভেশন আর্মি ‘আরসা’র বক্তব্যের সঙ্গে। আরসার বক্তব্যটি আমার ভালোভাবে পড়ার সুযোগ হয়েছিল। তারাও একবোরে হুবহু এভাবেই বলেছিল যে আমরা হামলা করিনি, এটা ছিল আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা। বিশ্ববাসীকে তারা বলেছিল, আরসা কোনো উগ্রপন্থী সংগঠন নয় এবং হতেও চায় না, আল-কায়েদা বা আইএসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই; তারা শুধু রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার চায়। কিন্তু আরসার এ বক্তব্য তখন কেউ বিশ্বাস করেনি। অথচ এখন খুব ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, ‘রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা ও নির্যাতন পূর্বপরিকল্পিত।’ এবং বলা হচ্ছে, এটি একটি ‘পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা’।
আমার কথা হলো, যারা আরসাকে বিশ্বাস করিনি, তাদের জঙ্গি বলেছি, আইএস ও আল-কায়েদার দোসর বলেছি, তাদের জঙ্গিপনার ভয়ে নিরাপত্তা জোরদারের কথা বলেছি, তাদের হামলার কারণে নিরপরাধ রোহিঙ্গাদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে বলেছি, এমনকি গণহত্যার কারিগরদের বলেছি ‘আরসা’ দমনে যৌথ অভিযানের কথা, টক শোতে যারা গলা ফাটিয়েছি এই দেশে আরসার জঙ্গি কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা জানিয়ে, তাদের কী হবে? আমার খুব মায়া হচ্ছে তাদের জন্য, এখন তারা কি জাতিসংঘ দলের বক্তব্য মানবে নাকি পূর্বের অবস্থান বজায় রাখবে?
রোহিঙ্গা সংকটের সমস্যাগুলো এত জটিল ও বহুমুখী যে এর একমুখী সমাধানের চিন্তার সুযোগ নেই। তাই সংশ্লিষ্ট সব বিষয়েই আমাদের চিন্তা করতে হবে। বুঝতে হবে। আমি আজ লিখতে বসেছি রোহিঙ্গা সংকটের বহুমুখী যে সমস্যা, তা থেকে উতরানোর জন্য আমরা কী কী করছি বা আমরা আসলে ক’মুখী সমাধানের চিন্তাভাবনা করছি, সে বিষয়ে। এটা খুবই জরুরি এ মুহূর্তে। বিশেষ করে, যে সংকটের বয়স অলরেডি পৌনে দুই মাস হয়ে গেছে, তা মোকাবিলায় আমরা কতটা কী করেছি বা সামনে কী করতে হবে এবং তা কতটা দ্রুত বা কার্যকরভাবে, সে চিন্তা করার সময় হয়েছে বলে আমি মনে করি।
আমরা কি এই চিন্তা করেই বসে আছি যে, মিয়ানমার ১৯৯২-এর সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয়ভাবেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে নেবে? কিংবা আমরা কি চিন্তা করছি যে বৈশ্বিক চাপে, যে চাপ আসলে মৌখিক, মিয়ানমার খুব সহসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে নেবে? আসলে আমরা কী করছি।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তার অর্থ তুলে দিচ্ছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা। ত্রাণ তৎপরতার এ ধরনের খবর বেশ অনেক দিন পরেই শুনলাম। গত মাসে যেখানে সারা দিন সংবাদজুড়ে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতার খবর ছিল, এই মাসে কিন্তু সে রকমটা নেই। ফেসবুকের পাতাজুড়েও আর আগের মতো ‘ত্রাণ-সেলফি’ নেই। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার, আবেগের ঘোড়া বেশিদূর চলে না। বাংলাদেশিরা প্রতিবেশী এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের হওয়ায় নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীকে শুরুতে পড়িমরি করে ত্রাণ সহায়তার জন্য পাগল হয়ে গেলেও সময়ের ব্যবধানে তা কমে আসবে। কক্সবাজার ও টেকনাফে খবর নিয়ে জেনেছি, বাস্তবে এই মানবিক তৎপরতা কমেও গেছে।
ত্রাণের এই বিষয়টা কেবল একটি উদাহরণ। রোহিঙ্গা সংকটটাই পারলে বিভিন্ন পক্ষ আস্তে আস্তে ভুলতে চাইবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বক্তৃতা-বিবৃতি, চাপ প্রয়োগ, নিষেধাজ্ঞার হুমকি—সবই কিন্তু কমে আসছে। সামনে আরো কমে যেতে পারে। এমনকি লক্ষ করলে দেখবেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে, টিভি টক শো আর পত্রিকার কলামেও গত মাসের তুলনায় রোহিঙ্গা ইস্যু কম স্থান পাচ্ছে। লেখকদের কালিও বুঝি ফুরিয়ে যাচ্ছে! রোহিঙ্গা সংকটের বহুমুখী সমস্যার এটা একটা দিক। অন্তত বাংলাদেশের জন্য। কারণ, প্রায় নয় লাখ রোহিঙ্গা এই দেশের কাঁধেই জুড়ে বসেছে। মানুষের মনে ও সংবাদের পাতায় বিষয়টা দিনে দিনে গৌণ হবে—এ কথাটি বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে।
গত শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদ তৃতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা ইস্যুতে বসলেও ফল কিন্তু আগের দুবারের তুলনায় খুব যে ইতিবাচক, তা বলা যাবে না। কারণ, এবারও পরিষদ কোনো প্রস্তাব পাস করতে পারেনি। কফি আনানের সঙ্গে বসে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে। বলেছে, নিরাপত্তা পরিষদকে কিছু একটা পদক্ষেপ নিতেই হবে। কিন্তু এসব তো আগেও বলেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন। বিশ্বের বড় বড় নেতা সেপ্টেম্বর মাসে বহু বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু কিছুই কি হয়েছে? গত রোববার এক রাতেই নতুন করে আরো পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে টেকনাফের একটি সীমান্ত দিয়ে। যাঁরা এসেছেন তাঁরা বলছেন, সীমান্তের ওপারে আরো হাজার হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষায় আছে অনুপ্রবেশের জন্য। তাঁরা বলছেন, রাখাইনের পরিস্থিতি এখনো আগের মতোই আছে। সেখানে এখনো হত্যা-নির্যাতন-অগ্নিসংযোগ চলছে। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াচ্ছে?
মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের সেনাবাহিনী কার্যত বিশ্ব সম্প্রদায়ের কোনো কথা এখনো খুব একটা আমলেই নেয়নি। তারা তাদের সেই ‘পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা’র মিশন নিয়েই আছে। এবং তারা খুব ভালো করে স্টাডি করেই এবারের অভিযান শুরু করেছে বলে দিনে দিনে প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা ঠিকই জানত, প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাপী একটা প্রতিক্রিয়া হবে এবং সে প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়ার প্রস্তুতিও তারা সেরে রেখেছে। একসঙ্গে পাঁচ লাখ ঠেলে দেওয়ার পর এখন তারা অল্প অল্প করে বাকিদের পাঠাচ্ছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না, যদি আগামী পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে রাখাইনের সর্বশেষ রোহিঙ্গা পরিবারটিও বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এটা স্বীকার করেছেন, দ্বিপক্ষীয়ভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে না। আন্তর্জাতিক চাপ লাগবেই। হস্তক্ষেপ লাগবেই। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যার এই দিকটি বোঝা খুব জরুরি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের মতো পূর্বনির্ধারিত কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক থেকে, যেখানে মূলত সীমান্তের বিভিন্ন সাধারণ বিষয়ের ওপর আলোচনা ও সমঝোতা চুক্তি হওয়ার কথা, বেশি কিছু আশা করা হবে বোকামি। আমাদের অবশ্যই নিরাপত্তা পরিষদ বা এর প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হবে।
মিয়ানমারকে বশে আনতে হলে এবার ভিন্ন কিছু করতে হবে। ভিন্ন কূটনৈতিক উদ্যোগ লাগবে। এটা মাথায় নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। সেটা কী হতে পারে, তার সম্ভাব্য অনেকগুলো উপায়ের কথা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বিভিন্ন জায়গায় বলছেন। এর একটি হলো, মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে গণহত্যার অপরাধে অভিযুক্ত করে এখনই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা শুরু করা। তাতে যদি চীন রাশিয়া বাধা হতে চায়ও, দেশটির ওপর সংকট সমাধানে ভালো চাপ তৈরি হবে।
একটি সমস্যা এরই মধ্যে প্রকট হতে শুরু করেছে। সেটি হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিশেষ করে কক্সবাজারে, স্থানীয়দের মধ্যে রোহিঙ্গা-ভীতি। টেকনাফ ও উখিয়ায় এখন স্থানীয়দের চেয়ে রোহিঙ্গারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভুখা-নাঙ্গা এসব রোহিঙ্গার এমনিতেই আছে সামরিক জান্তার নির্মম অত্যাচারের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা, আছে প্রিয়জন হত্যার মতো বীভৎস দৃশ্য দেখার করুণ অভিজ্ঞতা। এদের অনেকেরই মানসিক অবস্থা খুব ভালো না। এরই মধ্যে স্থানীয় কিছু পরিবার অভিযোগ করেছে, মানবিক কারণে জায়গা দেওয়া কিছু রোহিঙ্গা এখন তাদের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আছে নিত্যপণ্যের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার বিষয়ও। আলুর কেজি সেখানে ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের এই সমস্যার দিকেও তাই সরকারকে নজর দিতে হবে। স্থানীয়দের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
মোদ্দাকথা, অতীত ভুলে যেতে হবে। অতীতে যেভাবে রয়েসয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলা করা গেছে তা এবার সম্ভব নয়। এবারের সংকটের মাত্রাও অতীতের মতো নয়। এবার সংকটের মাত্রা যেমন তীব্র তেমনি বহুমুখী। তাই এই সংকটের সমাধানে বহুমুখী উপায়ও আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। টেলিভিশনের পর্দা, পত্রিকার পাতা, নিরাপত্তা পরিষদ—সব ঝিমিয়ে পড়তে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ এবং এর সরকারকে ঝিমিয়ে পড়লে চলবে না।
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি।