ঢাকা অ্যাটাক
বাংলা চলচ্চিত্রের পালে দখিনা হাওয়া
ঐতিহ্যের গৌরবময় যে ইতিহাস অবহেলা-অযত্নে খুইয়ে ফেলি আমরা, তা ফিরিয়ে আনাটা অসম্ভব কিছু নয়। এই গ্রহে একমাত্র মানুষের সম্ভাবনাই অপার। যদি থাকে নিষ্ঠা, সুযোগ আর সদিচ্ছা। কদিন আগেও আমরা বলতাম, অতল অন্ধকারে হারাচ্ছে বাংলা চলচ্চিত্র। কিন্তু পুলিশ থ্রিলার ‘ঢাকা অ্যাটাক’ আমাদের ধারণা আমূল বদলে দিচ্ছে। দেশজুড়ে হলের পরিবেশ খারাপ থাকুক, নাক সিঁটকানো গন্ধ থাকুক, শব্দের ত্রুটি থাকুক আর এসি থাকলেও পয়সা বাঁচানোর অজুহাতে তা না চলুক, তবু মানুষ হলমুখী হচ্ছে। দলবেঁধে ঢাকা অ্যাটাক দেখছে সবাই। বক্স অফিস হিট বা হাউসফুল শব্দগুলোর বাংলা ভার্সন নতুন করে জানছে বর্তমান প্রজন্ম। নেট, কেবললাইন আর স্মার্টফোনের স্ক্রিনে বুদ হয়ে থাকা নতুন প্রজন্ম বড় পর্দার মাজেজাটা বুঝে যাচ্ছে। ঢাকাই মুভির অমানিশায় এ যে নিঃসন্দেহে সুখের আলোর ঝলকানি। আমরা হলে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখতে চাই। চলচ্চিত্রশিল্পের আধুনিকতায় হৈহুল্লোড়ে মাততে চাই। এবার দীপঙ্কর দীপনদের মতো নির্মাতা ও সানী সানোয়ারদের মতো তরুণ গল্পকারদের প্রমোট করার পালা।
শিল্প আর বিনোদনের বাতিঘর আমাদের দুঃখী ও বঞ্চিত প্রজন্মকে বিপথগামিতা থেকে বাঁচানোর পথ দেখাক। অপরাধের হোতা মানসিক বিকারগ্রস্ত জিসানদের সময় এবার থমকে দাঁড়াক। আবিদ, চৈতি, আশাফাক আর সাজেদুলদের হাত ধরে স্থিতি ও শান্তি ফিরুক বাংলায়। রাষ্ট্র নিক অগ্রণী দায়িত্ব। তারপর মননশীল মানুষেরা আবার হামলে পড়ুক ‘হাউসফুল’ মুভি নির্মাণে। লাভ-ক্ষতির অঙ্ক নয়, আমরা যেন সবার আগে প্রাগ্রসর পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই। ভালো চলচ্চিত্রের সুবাতাসে সুদে আসলে ষোলআনা সুসময় একদিন আমাদেরই হবে।
রোজকার নানা জটিলতায় ত্যক্ত-বিরক্ত একগুয়ে জীবনে যেকোনো সুখবর আমাদের মন ভরায় ক্লান্তিহারা দখিনা হাওয়ার মতোই। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ বাংলা চলচ্চিত্রের পালে তেমনই দখিনা হাওয়া। অভিবাদন ঢাকা অ্যাটাকের নির্মাতা, কলাকুশলী, প্রডিউসার ও স্পন্সরদের।
আমাদের এখানে হেটারের অভাব নেই। কিন্তু বড় অভাব সমঝদার শিল্প সমালোচকের। ছিদ্র খুঁজতে গেলে প্রকৃতিকেও নিরঙ্কুশ নিঁখুত পাওয়া যাবে না। ঢাকা অ্যাটাকে কার অভিনয় হয়নি, কার গুরুত্ব কমবেশি হয়েছে, আরিফিন শুভ কেন ছবির প্রথম দিকে জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারলেন না, মাহিয়া মাহির মেয়েলিপনা কেন এড়ানো গেল না ইত্যাদি নানা কথায় বিরুদ্ধবাদীরা সরব হতেই পারেন। কিন্তু একজন ইতিবাচক মানুষ হিসেবে আমরা দেখব চলচ্চিত্রটির গ্রহণযোগ্যতার প্যারামিটার। পুলিশিং বোঝাটা সাধারণের কর্ম নয়, তবু সবাই দুই ঘণ্টা ২৭ মিনিট ব্যাপ্তির এই মুভিতে নিমগ্ন থাকছেন। রাজধানীর অভিজাত সিনেপ্লেক্সগুলোতে টিকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি দেখা গেছে। স্মরণকালের কোনো চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে আমরা মনে করতে পারি না। সারা দেশের শতাধিক হলে দ্বিতীয় সপ্তাহেও চলচ্চিত্রটি চালাচ্ছেন হলমালিকরা। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বিশ্বব্যাপীও মুক্তি পাচ্ছে এটি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এলিট ফোর্সের সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযানকে কেন্দ্র করে ছবির গল্প গড়ে তোলা হয়েছে। দেশের প্রতিরক্ষা স্তর ধ্বংস করে দিতে চায় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের সংশ্লিষ্টতাসহ একটি অপরাধী চক্র। পুলিশ তার কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেও অপরাধী চক্রকে পাকড়াও করে তাদের দায়িত্বপরায়ণতা দেখায়। মোটের ওপর এটাই হলো আসল গল্প। পুরোদস্তুর এমন পুলিশনির্ভর গল্পের যথার্থ গল্পকার সানী সানোয়ার। যিনি নিজে এখন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার। যিনি কি না মাত্র কিছুদিন আগেই পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। আর ঢাকা অ্যাটাক চলচ্চিত্রের নায়ক আবিদ ওই ইউনিটপ্রধান তথা বোমা নিষ্ক্রিয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে রোল প্লে করেছেন। এক কথায় সানী তাঁর বায়োগ্রাফিটা সুনিপুণভাবে আবিদরূপী আরিফিন শুভর ওপর আরোপ করেছেন। চলচ্চিত্রটির ভাবনা ও তদারকি যেহেতু সানী সানোয়ার করেছেন এবং নিজে গল্প সাজিয়েছেন, তাই আখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা পূর্ণতা পেয়েছে খুব স্বাভাবিকভাবে। পুলিশের ড্রেস, উইপন এবং অভিযান বাস্তবানুগ হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে হলি আর্টিজান ট্রাজেডি, স্ত্রী সালমার গর্ভে মেয়েসন্তান রেখে গোয়েন্দা পুলিশের অ্যাসিট্যান্ট কমিশনার রবি কামরুলের অকালপ্রয়াণ এবং এর পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী জঙ্গি নির্মূল অভিযানের বাস্তবতায় ছবিটি নির্মাণ এবং এ সময় মুক্তি দেওয়াটা বড় প্রাসঙ্গিক হয়েছে। কিছু সাময়িক সাফল্য পেলেও শেষ পর্যন্ত সমাজবিরোধীরা নয়, জয়ী হয় সমাজ বিনির্মাণকারীরা –এই মেসেজটাও সময়োপযোগী।
ঘটা করে গণহারে এখন আর কেউ হলে চলচ্চিত্র দেখতে যায় না। তবু যেসব বাংলা চলচ্চিত্র দর্শক রোজকার প্রেমকাহিনী, অর্থ ও নারীলোভী চিরাচরিত মন্দলোক এবং অসাধু পুলিশিং দেখতে দেখতে যখন বিরক্ত সে সময় আবিদের মতো দেশপ্রেমী পুলিশ হিরো আর জিসানের মতো আন্তর্জাতিক লেভেলের ভিলেন দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হচ্ছে। এমনটা তারা হলিউডি বা বলিউডি মুভিতে দেখে অভ্যস্ত। জিসানরূপী বাংলা চলচ্চিত্রের আনকোরা ভিলেন তাসকিন রহমানে এখন মুগ্ধ সবাই। তাঁর অ্যাক্টিং, ভয়েস, বডি ল্যাংগুয়েজ আর ভিন্নমাত্রার চোখ জানান দিচ্ছে বহুদূর যাবেন তিনি।
ছবির দৃশ্যায়ন ও গল্পের টুইস্ট থেকে শুরু করে এর সকল বিভাগ মান ধরে রেখেছে। আবহ সংগীত ছিল মনোমুগ্ধকর। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের লেখা অরিজিৎ সিং ও সোমলতার কণ্ঠে ‘টুপ টাপ’ এবং আসিফ ইকবালের লেখা অদিতের ভয়েস ও কম্পোজিশনে ‘পথ যে ডাকে দূরের পথে’ থিম সংটি অসাধারণ লেগেছে। বাণিজ্যিক ছবির আইটেম গানের হালের ট্রেন্ড মেনে মতিন চৌধুরীর কাওয়ালি ধাঁচের ‘আরে টিকাটুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে’ গানটি হারানো দিনের চলচ্চিত্রপ্রেমটাই যেন বা জাগিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিগ বাজেটের এই মুভিটিতে বিনোদনের এত অনুষঙ্গ থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ঢাকা অ্যাটাক একটি কংক্রিট পুলিশিং টেক্সট মুভি। সাধারণ মানুষ মুভিটি দেখছে পুলিশি সাহসিকতার থ্রিলিং উপলব্ধি করতে। পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা সোয়াট বা বোম্ব ডিসপোজাল টিমের গোপনীয় কার্যক্রম বা তাদের রণকৌশল সাধারণে প্রকাশ করবার কথা নয়। চাইলেও কেউ দেখতে পাবেন না। কিন্তু এই মুভিটিতে পুলিশিং-এর দুর্ধর্ষ ক্রিয়াকর্মের একটা অনুপুঙ্খ সাজেশন সবাই পেয়েছেন এবং আগ্রহভরে তা উপভোগও করছেন। তবে দেশাত্মবোধের গর্ব থেকে সকল নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, তাঁদের পরিবার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলী, সমর বিশারদ এবং ক্রিমিনলোজির শিক্ষার্থীদের এই চলচ্চিত্রের পাঠ গ্রহণ অবশ্যকর্তব্য।
সর্বত্র ঢাকা অ্যাটাকের জয়জয়কারে গল্পকার সানী সানোয়ার তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে চলচ্চিত্র দর্শক ও মুভিটির সঙ্গেহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লিখেছেন, আমাদের দেশ, মানুষ, সংস্কৃতি, ভাষা এবং সিনেমার জয় হোক। আর আমাদের সবার সমন্বিত প্রত্যাশাও সানীরই অনুবর্তী। ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। সকল নেতিবাচকতা দূরে রেখে সেই সব সৎ পুলিশ কর্মকর্তা নিজেদের জীবন দিয়ে যাঁরা আমাদের রক্ষা করেন, নিরাপদ রাখেন, রাতের ঘুম নিশ্চিত করেন তাঁদের বন্দনা করতেই হবে।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের পাঠ নেওয়া দীপংকর দীপনের নিশ্চিতই চলচ্চিত্রের বরেণ্য পুরুষ মার্কিন আলফ্রেড হিচককের ফিল্মি ফিলোসফি জানা আছে। হিচকক পরিচালিত ৬০-এর দশকের সাসপেন্স থ্রিলার, হরর এবং মনোজাগতিক জটিলতা ও মনোবিকারিক বিখ্যাত ছবি ‘সাইকো’। রবার্ট ব্লখের ‘সাইকো’ উপন্যাস অবলম্বনে মানসিক বিকৃতিতে আক্রান্ত এক খুনিকে ঘিরে এর গল্প আবর্তিত। চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যান্টনি পারকিনস, যাকে পৃথিবীর সেরা খলনায়কদের তালিকায় এক নম্বরে স্থান দেওয়া হয়।
ঢাকা অ্যাটাকেও ‘সাইকো’র মতোই জিসান নামের একজন ক্রিমিনালের মনোবিকার নিয়ে একধরনের গবেষণা উপস্থাপিত হয়েছে। আবাল্যের অশান্তি ঢাকতে সিরিয়াল কিলিং-এ মানুষ মুক্তি খোঁজে। নিপীড়ন আর নির্মমতার শৈশবই ছিল জিসানের। যদিও ঢাকা অ্যাটাকের প্রধান চরিত্র পুলিশ। তবে ২০১৯-এ পর্দায় আসা ঢাকা অ্যাটাকের সিক্যুয়েল ‘ঢাকা অ্যাটাক এক্সট্রিম’-এ খলচরিত্রের ওপর আরো মনোযোগ দিতে পারেন নির্মাতা। আমাদের নীল চোখের তাসকিন রহমান আগামীতে আরো গভীর মনোযোগে অপরাধীর মনস্তত্ত্ব আঁকতে গিয়ে হতেই পারেন বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা খলনায়ক। আগত সেই ছবিটি লেখক ও নির্মাতা আরেকটু হিউমার, উইট ও নিষ্কলুষ বাড়তি বিনোদনে সাজাতে পারেন। যেখানে নারী চরিত্ররা কেবল ক্রন্দন পটীয়সী অবলা না হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে হতে পারে পুরুষের গর্বিত সঙ্গী।
সর্বসাফল্য মিলিয়ে ঢাকা অ্যাটাক বাংলা চলচ্চিত্রের নিজের হারানো পথ ফিরে পাওয়ার ছবি। শিল্পপ্রেমী দর্শক আর স্বপ্নবাজ নির্মাতাদের আত্মবিশ্বাস ফেরানোর ছবি। ইতিহাসের বাঁকবদল ফেরায় সুবর্ণ সময়। ঢাকা অ্যাটাক হোক সেই গৌরবের ইতিহাস।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন