শিশু অধিকার সপ্তাহ
শুধু শোভাযাত্রার মডেল যেন না হয় পথশিশুরা
শিশু অধিকার সপ্তাহ চলছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিশু সংগঠনগুলো তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে শিশুদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করার।
শিশু একাডেমি তাদের ৬৪ জেলায় কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। ঢাকায়ও একাডেমি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনগুলো নানা ধরনের সেমিনার করে শিশুদের নিয়ে তারা বছরজুড়ে কী কী কার্যক্রম পরিচালনা করে তার ফিরিস্তি দিয়ে চলছে। পথশিশুদের নিয়ে শোভাযাত্রাও করছে। ভালোই জমে উঠেছে শিশু অধিকার সপ্তাহ।
অক্টোবর মাস এলেই শিশুদের নিয়ে বাংলাদেশ মেতে ওঠে। বিশ্ব শিশু দিবস পালন করা হয়। প্রতিটি শিশুকে তার অধিকার দিতে হবে, বাড়িতে যে কাজের শিশুটি রয়েছে তাকে যেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে অক্ষরজ্ঞান দেওয়া হয়, সেই বিষয়ে নানা ধরনের প্রচারণা চালানো হয়।
কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই মাসটি চলে যাওয়ার পর শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো আর ওই সব নীতিবাক্য মনে রাখে না। তারা ভুলে যায় যাদের পথ থেকে ডেকে এনে শোভাযাত্রা করিয়েছিল, তাদের। যাদের গায়ে নতুন পোশাক পরিয়ে ফটোসেশন করেছিল, তাদের। দুপুরে এক প্যাকেট বিরিয়ানি ধরিয়ে দিয়ে সেলফি তুলেছিল, তাদের। কারণ ওসব যা কিছুই করা হয়েছিল তা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। যার ভেতর রয়েছে মেকি ভাব। ওই সব ছবি সুভেনিরে ছেপে ব্যাপক কার্যক্রমের গল্প প্রকাশ করে দলিল হিসেবে রেখে দেওয়াটাই কাজের কাজ। বিদেশ থেকে যাদের টাকায় ওই সব এনজিও চলে তাদের কাছে ওই সুভেনির পাঠাতে হবে। তা হলেই পরবর্তী ফান্ড পেতে সুবিধা হয়।
এই হচ্ছে আমাদের বেশির ভাগ শিশুদের নিয়ে কাজ করা এনজিওর আসল কাজ। পাশাপাশি শিশুদের জন্য অন্য যারা কাজ করে তারাও কতটা আন্তরিক সে ব্যাপারে রয়েছে সন্দেহ।
শিশু অধিকার দিবসের সভা-সেমিনারে আমরা অনেক বক্তাকে আবেগ-আপ্লুত হয়ে উঠতে দেখি। পথশিশুদের নিয়ে তারা অনেক চিন্তা ভাবনা করে, তারা শিশুদের কষ্টময় জীবনের কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি ধরে রাখতেও পারে না অনেক সময়। হায়রে ভণ্ডামি।
তবে শিশুদের নিয়ে কাজ করা দুএকটি সংগঠন যে একেবারেই কিছু করে না, তা নয়। তবে ওই সব সংগঠনের রয়েছে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা। তারা যে ধরনের কাজ করতে চায় তার জন্য প্রয়োজন অর্থের। সেই ধরনের অর্থ তাদের না থাকলেও চেষ্টা করে কিছু করার। সরকারিভাবে এরা তেমন সহযোগিতাও পায় না।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তা হলে কীভাবে শিশুদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলো বিদেশ থেকে ফান্ড কালেকশন করে? তাদের স্বচ্ছতার ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো তদারকি করার ব্যবস্থা আছে কি না। সেখানেও গলদ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেখা গেছে প্রতিটি এনজিওর সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত থাকে। যাদের সাথে রয়েছে সরকারের ওপর মহলের চমৎকার যোগাযোগ। এর ফলে সরকারিভাবে যেসব তদারকি করার প্রয়োজন আবশ্যিক তা করা হয় খুবই ঢিলেঢালাভাবে। যে কারণে ওই সব এনজিওর স্বচ্ছতার বিষয়টি থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
যাদের কথা বলে বিদেশ থেকে ফান্ড কালেকশন করা হয়, তাদের জন্য পুরো ফান্ডের ১০০ ভাগের ১০ ভাগও যদি খরচ করা হতো তাহলেও দরিদ্র শিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা উপকৃত হতো, এমন কথা বললেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিশু সংগঠক।
অভিযোগ রয়েছে এসব এনজিওর কর্তাব্যক্তিরা নিজেরা গাড়ি বাড়ি করে ওই ফান্ড থেকেই। তবে তারা ভালো জানে কাদের কাদের মুখ বন্ধ করে রাখলে তাদের এই অনৈতিক বিষয়টি প্রকাশ হবে না। সেইমতে তারা হাতে রাখে সমাজের সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজন থেকে শুরু করে অনেক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকেও। এসব মানুষের জন্য তাদের রয়েছে আলাদা বরাদ্দ। বছরের কোনো কোনো সময় খামে করে উপঢৌকন পৌঁছে দেওয়া হয় তাদের।
যাদের কাছে উপঢৌকন পৌঁছে তাঁরাও নাকি প্রথমে বুঝতে পারে না, কেন তাদের অর্থ দেওয়া হয়। পরে জানতে পারে অমুক এনজিওর তমুক কর্তাব্যক্তি তাকে ওই খাম পাঠিয়েছে। কারণ তিনি নাকি ওই সংগঠনের ছায়া উপদেষ্টা হিসেবে আছেন।
শিশু অধিকার সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। আগামীতেও পালন করা হবে। আমরা আশা করব শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করে, তারা মনেপ্রাণে যা বিশ্বাস করে তাই যেন পালন করে। লোকদেখানো আর শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে তা যেন সীমাবদ্ধ না থাকে।
প্রতিটি শিশু তার মৌলিক অধিকার নিয়ে বেড়ে উঠুক, একদিনের জন্য সুন্দর পোশাক পরে শোভাযাত্রার মডেল যেন না হয় কোনো পথশিশু। তাদের নিয়মিত বই পড়ার সুযোগ দেওয়া হোক। একদিনের জন্য ভালো খাবার না খাইয়ে প্রতিদিন যেন চারটা ডাল-ভাত খেতে পারে সেভাবে কাজ করবেন আমাদের এনজিওগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। এতে না হয় তাঁদের বিলাসবহুল জীবনযাপন থেকে সামান্যই খরচ কমল। খুব বেশি কি সমস্যা তাতে? সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে থাকুন এবং ভালো রাখুন ওদের।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।