ডিম নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড
শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে- ডিম নিয়ে আবার লঙ্কাকাণ্ড হয় কীভাবে? ডিম দিবসের ডিম কাণ্ড নিয়ে লিখতে গিয়ে এই শিরোনামটাকেই আমার কাছে যুতসই মনে হলো। আসলেই গতকাল (শুক্রবার) ডিম দিবসে ডিম নিয়ে যা ঘঠেছে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যেভাবে বিষয়টি ভাইরাল হয়েছে মূলত সেই কারণেই এমন একটি শিরোনাম দিতে বাধ্য হলাম।
গতকাল শুক্রবার ছিল বিশ্ব ডিম দিবস। প্রাণিজ আমিষের চাহদিা পূরণ, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠন এবং সর্বোপরি ডিমের গুণাগুণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে এ দিবস বিশ্বজুড়ে একযোগে পালিত হয়ে আসছে।
তাই দিবসটি উপলক্ষে বাজারে যে ডিম সাত টাকার কমে পাওয়া যায় না, সেই ডিমের দাম মাত্র তিন টাকা। কম মূল্যে এ ডিম কিনতে সকাল থেকে উপচে পড়া ভিড়। হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে ব্যাগ, হাঁড়ি-পাতিল ও বালতি নিয়ে তিন টাকা দামের ডিম কিনতে। ভোর হওয়ার আগেই ভিড়। অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েও তাদের ডিম দিতে পারেনি আয়োজকরা। ডিম না পেয়ে দফায় দফায় সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। মানুষের ভিড়ে অনেক ডিম ভেঙে গেছে।
এ তিন টাকার ডিম বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। সে জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে ডিম বিক্রির এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। কথা ছিল, শুক্রবার বিশ্ব ডিম দিবসে ঢাকার খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত ডিম বিক্রি হবে। জনপ্রতি কেনা যাবে সর্বোচ্চ ৯০টি ডিম।
কম মূল্যের ডিম কিনতে সকাল ৮টার মধ্যে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। ৯টায় ক্রেতাদের লাইন বিজয় সরণি পার হয়ে যায়। এক কিলোমিটারের ওপরে চলে যায় ডিম ক্রেতাদের লাইন। এ লাইন নিয়ন্ত্রণে তখনই মোতায়েন করতে হয় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। নানা বয়সের, নানা পেশার মানুষ ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ডিম কিনতে জড়ো হয়েছিল খামার বাড়িতে। শুক্রবার হওয়ায় এই ভিড় আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তবে ১০টায় ডিম বিক্রি শুরুর কথা থাকলেও আরো পরে তা শুরু করে আয়োজকরা, যা নিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ক্রেতারা।
ক্রেতারা তিন-চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ১০টার আগেই হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। শুরুতে লক্ষ করা যায় চরম অব্যবস্থাপনা। যে পরিমাণ কাউন্টার ডিম বিক্রির জন্য করা উচিত ছিল তার চেয়ে কাউন্টার ছিল হাতেগোনা। আর যারা ডিম দিচ্ছিল তারা ভাঙা ও পচা ডিমও কার্টনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। এ নিয়ে আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ক্রেতারা। এক সময় সেই বিক্ষোভ আয়োজকদের সাথে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। একপর্যায়ে পুলিশ ক্রেতাদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে। বিক্ষোভ, হাতাহাতি আর পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে শুরুতেই পণ্ড হয়ে যায় তিন টাকার ডিম বিক্রি।
একপর্যায়ে ক্রেতাদের ধাক্কাধাক্কিতে কেআইবি মিলনায়তনের বাইরে খালি জায়গায় ডিম বিক্রির জন্য বানানো প্যান্ডেল ভেঙে যায়। ভিড়ের চাপে ভেঙে যায় কাউন্টারে রাখা বেশ কিছু ডিম। দিবসটি পালনে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির জন্য ডিম এনেছিল আয়োজকরা। সকাল ১০টায় বিক্রি শুরুর কথা থাকলেও ক্রেতাদের ভিড় দেখে তারা ৯টা থেকেই বিক্রি শুরু হয়।
তবে বাস্তবতা হলো- আয়োজকরা যে পরিমাণ ডিম এনেছিলেন তার চেয়ে বেশি এসেছিলেন ক্রেতা। সব ক্রেতার মধ্যে একটি করে ডিম ভাগ করে দিলেও সব ক্রেতাকে দেওয়া সম্ভব ছিল না। একজন ক্রেতাকে ৯০টি ডিম দেওয়ার কথা। কিন্তু কেউ ওই পরিমাণ ডিম কিনতে পারেছে বলে আমার মনে হয় না। তাই ক্রেতাদের চাপে তারা ১০টার আগেই ডিম বিক্রি বন্ধ ঘোষণা করেন। এর আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
এদিকে, ডিম বিক্রি বন্ধ হওয়ার পরে কাউন্সিলের সভাপতি মসিউর রহমান ফেসবুকে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ডিম দিবস উপলক্ষে আমরা সাধারণ মানুষকে একটি বার্তাই দিতে চেয়েছিল তা হলো ডিম একটি পুষ্টিকর খাদ্য এবং সবার ডিম খাওয়া দরকার। আমরা চেয়েছিলাম সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষরা যেন কম দামে পরিবারের জন্য এক মাসের ডিম কিনে নিয়ে যেতে পারেন।
কিন্তু যে ক্রেতারা ডিম কেনার জন্য এসেও ডিম কিনতে পারো না, তাদের বিক্ষোভ একপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। রাস্তার ওপর যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন পুলিশ ক্রেতাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে ক্রেতারা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
আয়োজকেরা যখন ডিম বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে মাইকে সবাইকে বাসায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছিল তখন ক্রেতাদের ডিম চাই, ডিম চোরদের বিচার চাই, ইত্যাদি স্লোগান দিতে শোনা যায়। ডিম ভর্তি গাড়ি যখন চলে যাচ্ছিল তখন ওই গাড়ির পেছনে মানুষকে ধাওয়া করতে দেখা যায়।
এদিকে ডিম নিয়ে এই হুলস্থূল কাণ্ড গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল। অনেকেই এটিকে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করে। নানা রসাত্মক কথাবার্তায় অনেকে লেখেন। আবার অনেকে বলেন, এটি নীরব দুর্ভিক্ষের একটি বাস্তব ছবি। কম দামে ডিম কিনতে এত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে তা মনে হয় আয়োজকরাও ভাবতে পারেননি।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।