দৃষ্টিপাত
বুদেকিনের ব্লু হোয়েলের নীল দংশন
১.
ট্র্যাজেডিই পৃথিবীর নিয়তি। তাই হয়তো তাকে ঢেকে রাখবার দায়বোধ দেখায় নীলাকাশ। নীলটা কারুণ্য বা বিষাদেরই রং। পুরাকালে সমুদ্র মন্থনে উত্থিত অমৃত দেবতারা গ্রহণ করবার পর অসুররা বেপরোয়া মন্থন শুরু করলে অমৃত হয়ে যায় হলাহল বিষ। সেই বিষে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রাণিকুল বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। সেই বিষ থেকে সুরক্ষা পেতে দেবতারা মহাদেব শিবের শরণাপন্ন হলে তিনি ওই বিষ শোষণ করেন। বিষের প্রভাবে তাঁর কণ্ঠ নীল বর্ণ ধারণ করলে শিবের নাম হয়ে যায় নীলকণ্ঠ।
মাত্র শতবর্ষ আগে এই বঙ্গভূমিতে ব্রিটিশদের জোরজবরদস্তিতে পড়ে বাংলার কৃষকসমাজ নীল চাষে বাধ্য হয়েছিলেন। নীলকর বা নীলকুঠি শব্দগুলো এখনো ঔপনিবেশিক অতীত ইতিহাসের ট্র্যাজিক বিবমিষা।
ভিসিআর, ডিভিডির যুগ পেরিয়ে এই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ইউটিউবের যুগে নীলফিল্ম এখন মূল্যবোধ বিনষ্টের প্রধান প্রতিভূ। সেইসঙ্গে নীলরঙা থিম কালার নিয়ে ফেসবুক ও টুইটার নামের সোশ্যাল মিডিয়া মাদককেও হার মানিয়ে দেওয়া বিপজ্জনক নীল নেশার নাম।
এমন একটা সময়ে বিশ্বব্যাপী হানা দিয়েছে নীল তিমি তথা ‘ব্লু হোয়েল’ নামের মারণঘাতী গেম। এই গেমের প্রণেতা ফিলিপ বুদেকিন মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাটাছেঁড়া করবার প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল, সমাজের জন্য যেসব মানুষ অপ্রয়োজনীয় এই গেমের ফাঁদে ফেলে পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের তিনি ধ্বংস করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মনোবিজ্ঞানে পাঠ নেওয়া বুদেকিনের শৈশবটা নষ্ট করেছিলেন তাঁর মা ও বড় ভাই। আবাল্যের সেই মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়ানোর ফলই মানবতাবিরোধী এমন বিকৃত গেম।
ওই গেমের কিউরেটর সন্দেহে ২০১৬ সালে ২২ বছর বয়সী বুদেকিন পুলিশের কাছে ধরা পড়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। তিন বছরের কারাদণ্ডও ভোগ করছেন তিনি। কিন্তু তাঁর বানানো গেমের ভাইরাস এখনো হানা দিয়ে চলেছে বুদেকিনের ভাষায় নির্বোধ বর্জ্যমানবের আস্তানায়।
বুদেকিনের এই গেমের এমন নেশা যে, খেলতে খেলতে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে গেমের ক্রীড়নকদের কাছে সহাস্যে নিজের জীবন তুলে দিচ্ছে গেমার শিশু-কিশোর কিংবা তরুণ-তরুণীরা। এমন নীলস্রোতের জোয়ার থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। ধারণা করা হচ্ছে ‘ব্লু হোয়েলে’র কাছে প্রাণ সঁপেছে ঢাকার হলিক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা। তবে স্বর্ণার পরিবার এই আত্মহত্যার সঙ্গে ‘ব্লু হোয়েল’ সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে আরো কয়েকজন গেমের চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দিন কাটাচ্ছে। সরকারের তরফেও গেমটির বিস্তার বন্ধে বিটিআরসিকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
২.
২০১৩ সালে রাশিয়া থেকে এই গেমের যাত্রা শুরু হয়। এখন বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের অপর নাম ‘ব্লু হোয়েল’। এরই মধ্যে গণমাধ্যম থেকেই সবার জানা হয়ে গেছে, এটি অনলাইনভিত্তিক একটি গেম। অনলাইনে কমিউনিটি তৈরি করে চলে এর প্রতিযোগিতা। এতে সর্বমোট ৫০টি ধাপ রয়েছে। এই গেমের মডারেটর বা অ্যাডমিনের কাছে একজন গেমার নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় রোমাঞ্চ উপস্থাপন করে গেমারকে হিপ্নোটাইজ করে ফেলে গেমটির অ্যাডমিন। যেমনটা ধর্মের নামে উগ্রবাদী আত্মঘাতী তরুণদের মগজ ধোলাই করে তাদের ক্রীড়নকরা। গেমার অ্যাডমিনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে একরকম বাধ্য হন মধ্যরাতে ভূতের সিনেমা দেখতে, খুব সকালে ছাদের কিনারা দিয়ে হাঁটতে, অসচেতনতায় রেললাইন ধরে হাঁটতে কিংবা ব্লেড দিয়ে হাতে তিমির ছবি আঁকতে। আবার সেসবের ছবি তুলে গেমের নিয়ন্ত্রকের কাছে পাঠিয়ে নিজেকে হিরো প্রমাণ করবার সুবর্ণ সুযোগ রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত নেশাটা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যে, নিয়ন্ত্রক গেমারের জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলতে পারেন। এ খেলার সর্বশেষ ধাপ হলো আত্মহত্যা করা। অর্থাৎ গেম শেষ করতে হলে প্রতিযোগীকে আত্মহত্যা করতে হবে। এরই মধ্যে সারা বিশ্বে অন্তত ৩০০ জনের প্রাণ গেছে এই গেমের ফাঁদে পড়ে। এনডিটিভির খবর থেকে জানা যাচ্ছে, সম্প্রতি ভারতের রাজস্থানে মরণ খেলা ‘ব্লু হোয়েলে’র হাত থেকে গেমার এক ছাত্রের প্রাণ বাঁচিয়েছেন তার শিক্ষক।
বিষয়টি থেকে খুব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এই গেমে নাম লেখাতে হলে একজন গেমারকে ইন্টারনেট সংযোগসহ স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার থাকতে হবে। এই যুগে এসব কতই না সহজলভ্য, যা আমাদের শিশুরাও নির্বিঘ্নে ব্যবহার করতে পারে!
আমরা আধুনিক বাঙালিরা ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন বুঁদ হয়ে আছি। বিশেষ করে রোজকার ঘটনা ফেসবুকে আপডেট না করতে পারলে সেটাকে আমরা অপূর্ণতা হিসেবেই ধরে নিচ্ছি। কার কত লাইক কিংবা ফলোয়ার এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। মেসেঞ্জারের লাইভে লাইভে রোজ নির্মিত হচ্ছে হাজার অনাচারের বিবর্ণ ইতিহাস। মানবীয় সম্পর্ক এখন অবিশ্বাস আর লুকোছাপার নামান্তর। আস্থা বলে কোথাও কি আর কিছু আছে?
মূলত ইন্টারনেট, ফেসবুক বা ইউটিউবের এমন রমরমা অবস্থা থেকে শিশুদেরও বাইরে রাখা যাচ্ছে না। সার্চ ইঞ্জিন ‘গুগল’-এর কাছে চাইলে মেলে না এমন কোনো তথ্য আর এখন নেই। ভয়াবহ অবস্থাটা হলো এসব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো ফিল্টারিং বলে কিছু নেই। এখন সেই ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের পথ ধরে যদি এক অশুভ ভয়াল অন্ধকার আমার দেশে হানা দেয় তা নিরোধ করবে কারা?
৩.
দায়িত্ব এখন আমার আপনার নিজেরই। সন্তানরা বিপথগামী হচ্ছে। অন্ধকারে ডুবসাঁতার খেলছে নতুন প্রজন্ম। তাদের ইন্টারনেট ব্যবহার মনিটর করুন। তবে শিশুর মন বুঝে। তাকে আঘাত করে বা বিগড়ে দিয়ে নয়।
শিশুরা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। নতুন কিছুতে মজে যাওয়া তাদের চিরায়ত স্বভাব। তাদের সেই স্বভাব বা সেই ভালোবাসার মোড়টা ঘুরিয়ে দিন বই পড়ায়, ভ্রমণে, খেলাধুলায়, সংস্কৃতি চর্চায়। গোঁড়ামি বা উগ্রতাটুকু বাদ দিয়ে শিশুকে ধর্মাচার শেখান। নীতিশাস্ত্রের ঔদার্যবাদ তাকে রপ্ত করাতে হবে। শিশুর অবসাদ, নৈরাশ্য বা হতাশা দূর করতে হবে। যে করেই হোক ইন্টারনেটের বাইরে এসে শিশুর অন্য আনন্দকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
আবার ফিরিয়ে আনুন অতীত। বাসায় ছিমছাম লাইব্রেরি গড়ে তুলুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় গা ভাসানো শিশুদের কর্ম নয়; এ থেকে বিরত রাখবার প্রতিজ্ঞা বড়দেরই নিতেই হবে। পড়াশোনার ফাঁকে রোজ করে বিশ্বসাহিত্য, ইতিহাস বা বিজ্ঞান পাঠে তাকে সঙ্গ দিন। একাকিত্ব যেন কিছুতেই গ্রাস না করে, খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে ঘটা করে বিশ্ববিখ্যাত শিশুতোষ চলচ্চিত্র দেখান। ইন্টারনেটের আসক্তিমুক্ত করতে সনাতন পদ্ধতিটাকেও প্রাধান্য দিন। সন্তানকে বুঝাতে হবে, একজন অপরিচিত কিউরেটর, যাকে সে চেনে না জানে না তার কথা মেনে চলবার কোনো কারণ নেই। জীবন অনেক সুন্দর। অনেক কিছু জয় করবার আছে তার। ঈশ্বরের অমূল্য দান প্রাণকে অকালে নীল বিষে বিলীন করবার কোনো মানে নেই। না হলে নীল তিমির ভয়ংকর বিষে জর্জরিত হব আমরা সবাই। আধুনিক নীলকরের হাতে কেন তুলে দেবো অমৃত প্রাণ।
পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর জেরায় বুদেকিন বলেছিলেন, এই চ্যালেঞ্জের যারা শিকার, তারা এই সমাজে বেঁচে থাকার যোগ্য নয়। তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমি সমাজ সংস্কারকের কাজ করছি। কথাটাকে বেদবাক্য বলে মানুন, যারা বুদেকিনের মতো নারকীয় প্রেতাত্মার কথায় ওঠবস করে, তাদের কি আসলেই বেঁচে থাকা উচিত? বুদেকিন ফাঁদ গলায় নেওয়া কি মনুষ্যকর্ম হতে পারে? কিন্তু শিশুরা তো বুদেকিন নামের যমদূতকে চেনে না বা বুঝে না। শিশুর মস্তিষ্ক চলে আবেগে। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতা বলে তাদের কিছু নেই। কাজেই সব শিশু স্বর্ণা হয়ে ওঠবার আগেই তাদের নীল তিমির দানবটা থেকে আড়াল করে রাখতে হবে। অভিভাবক বা পিতামাতাকেই হয়ে উঠতে হবে নীলকণ্ঠি শিব।
অন্ধকার অমানিশা পেছনে ফেলে আলোর পথে যাত্রা হোক আমাদের। মানবীয় জানালা থাকুক উন্মুক্ত। বেঘোরে মরণ নয়, আনন্দ ও হৈ-হুল্লোড়পূর্ণ জীবন খুঁজে পাক আমাদের শিশুরা। দেখানো স্মার্টনেস নয়, শিশুর ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় লালিত হোক ফেলে আসা ঐতিহ্য। পুরোনো সেই দিনের কথা না ভুলে প্রাণের সখার সঙ্গে সুখের দুঃখের কথা বলবার প্রাণজুড়ানো মুহূর্তরা আবার ফিরুক রাবীন্দ্রিক বাংলা মানসে।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।