এ কেমন সর্বনাশা ‘গেম’?
আজ (৮ অক্টোবর) পত্রিকায় হলি ক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর সংবাদ দেখে অনেকের মতো আমিও ভীষণ অবাক হয়েছি। ব্যথিত হৃদয় দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়েছে। নিজেকে রীতিমতো অসহায় মনে হয়েছে।
পত্রিকায় এ সম্পর্কিত সংবাদ পড়তে গিয়ে অপূর্বার মৃত্যুর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তর দায় দেখতে পেয়েছি। কারণ ২০১৩ সালে রাশিয়ার বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ভিকে’ (VK)-তে F57 যা ‘ডেথ গ্রুপ’ নামে পরিচিত, সেখানে এ গেমটি চালু হয়।
আর এ আত্মঘাতী গেম ‘ব্লু হোয়েল’-এ আসক্ত হয়ে এবং ওই গেমের নির্দেশনা অনুসরণ করতে গিয়েই অপূর্বা আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথ বেছে নিতে বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। কারণ এ খেলার ৫০তম ধাপে (এটিই খেলার সর্বশেষ ধাপ) এসে নাকি খেলোয়াড়টিকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা দেওয়া হয়। শুধু প্ররোচনাই নয়; কীভাবে আত্মহত্যা করতে হবে (গলায় ফাঁস দিয়ে নাকি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে –এমন নানা নির্দেশনা) সে নির্দেশনাও নাকি দেওয়া হয়। অনেকে সে নির্দেশনা পালন করতে গিয়েই আত্মঘাতী হয়ে থাকে। মনে তাই প্রশ্ন জেগেছে, এ কেমন মরণ নেশার খেলা?
২০১৫ সালে মরণ নেশার এ গেম খেলতে গিয়েই রাশিয়াতে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। এভাবে ১৬ জন টিনএজারের মৃত্যুর পেছনে এ গেমের প্ররোচনা রয়েছে বলে যখন অভিযোগ ওঠে, তখন ফিলিপ বুদেকিন (Philipp Budeikin) নামের যে ছেলেটি উক্ত গেমের আবিষ্কারক দাবিদার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সারা বিশ্বে প্রায় ৩০০ ছেলেমেয়ে নাকি এ গেম খেলতে গিয়েই আত্মহত্যা করেছে। সার্বিক বিবেচনায় এটা স্পটতই আত্মহত্যা নয় বরং একদমই নির্ভেজাল হত্যাকাণ্ড। বলা যায়, ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ফিলিপ বুদেকিন (Philipp Budeikin) তা স্বীকারও করেছে। ভাবা যায়।
নষ্ট এ ছেলেটি এখনো জেলে রয়েছে ঠিকই তবে তার সর্বনাশা গেমের বিস্তার কিন্তু থেমে নেই। ভীষণ অবাক করার মতো ব্যাপারই বটে। এ ধরনের কন্টেন্ট বা গেম কীভাবে এখনো ইন্টারনেট দুনিয়ায় বহাল তবিয়তে আছে, সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না। কেনই বা এ গেমকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না সেটাও বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি। এ ব্যাপারে যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, তারা হয়তো ভালো বলতে পারবেন। আমি শুধু বুঝতে পারছি এ গেমকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। এবং খুব দ্রুততার সঙ্গেই সেটা করা উচিত। কীভাবে সেটা করা যায় সেটা নিয়ে বিটিআরসিকেই ভাবতে হবে।
যদিও এ গেমটি সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। অপূর্বার মৃত্যুর কারণেই এটা আমি জানতে চেষ্টা করেছি। তাও আবার ইন্টারনেটে প্রাপ্ত নানা সূত্র থেকেই। সেখানে দেখতে পেয়েছি, গেমটি শুরুর ধাপগুলোতে মজাদার নানা ইভেন্ট থাকলেও ধীরে ধীরে তা কঠিন হতে থাকে এবং বিকৃতমনা নানা ধরনের কাজের নির্দেশনা দিতে থাকে।
এভাবে নানা ধাপের নির্দেশনা পালন করতে করতে একসময় এ গেমটি কিশোর ছেলে-মেয়েটির মনোজগতকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলে। তারা তখন সত্যি সত্যিই গেমটির নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে থাকে। অনেকটা মাদকাসক্তের মতো। মাদক নিতে মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা যেমন উদগ্রীব থাকে, তেমনিভাবে এ গেমের নির্দেশনা পালন করতে কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরাও উদগ্রীব হয়ে পড়ে। ফলে চূড়ান্ত ধাপে এসে আত্মহত্যার নির্দেশনাকেও তারা আর অমান্য করতে পারে না।
অভিভাবকদের কাছে তাই অনুরোধ থাকবে তথ্যপ্রযুক্তির এমন অবাধ প্রবাহের যুগে আপনার সন্তান মোবাইল, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে কী করছে সে সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখুন। আড়ি পাতা নয় বরং বন্ধুর মতো মিশে তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। তাদের এ দুনিয়ার খারাপ দিক এবং ভালো দিক সম্বন্ধে ধারণা দিন। যেসব বন্ধু সবকিছুতেই অন্যের প্ররোচনায় ‘হ্যাঁ’ বলতে শেখে, তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলুন। তাদের ভেতরে কোনো হতাশা আছে কি না সে সম্পর্কেও খোঁজখবর নিন। কাদের সঙ্গে মিশছে, তার আচরণে কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে কি না সেটা প্রতিনিয়ত খেয়াল করুন। প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন।
‘ব্লু হোয়েলের’ মতো এমন সর্বনাশা না হলেও ইন্টারনেট জগতে আরো নানা ধরনের গেম আছে; যেগুলোর আসক্তিও ছেলেমেয়েদেরকে বিপথে চালিত করতে পারে। তাদের মনে হতাশা, রাগ, ক্ষোভ বা দুঃখকে বাড়িতে দিতে পারে। দেখা যায়, যে গেমটি তারা খেলছে সেটি ছেড়ে উঠে গেলেও তাদের মনে ওই গেমের পরবর্তী ধাপ বা বাধা সম্পর্কে প্রতিমুহূর্তে নানা রকম ভাবনা চলতেই থাকে। তার মানে হচ্ছে, সে আসলে যখন গেম খেলছে না তখনো গেমের জগতেই থেকে যাচ্ছে। ফলে, ফ্যান্টাসি বা কল্পবিলাস মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এর পরিণতি কিন্তু ভয়াবহ হতে পারে।
গেমগুলোর এক একটা ধাপ তারা নেশার মতো অতিক্রম করার চেষ্টা করে থাকে। পারলে খুশি হয়। না পারলে নিজেই নিজের ওপর চরম বিরক্তি প্রকাশ করে। বলা যায়, রীতিমতো একধরনের আসক্তিতে তারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে। একবার এ আসক্তিতে আক্রান্ত হয়ে পড়লে সেখান থেকে বের হওয়া খুব কষ্টকর। তাই খেয়াল রাখুন ছেলেমেয়েরা যেন এ ধরনের আসক্তিতে জড়িয়ে না পড়ে।
সবশেষে বলব, বাবা-মা এবং অভিভাবকদের যেমন ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রকেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। ইন্টারনেট দুনিয়ার যে বিষয়াবলি তা নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। সমাজ বিধ্বংসী বিষয়াবলি নজরে আসা মাত্রই তা বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ করতে হবে। না হলে সাইবার জগতের কথিত ভাইরাস ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকেই আক্রান্ত করে ফেলতে পারে। তাই, সাবধান থাকতে হবে সব সময়। কারণ সাবধানের মার নেই।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক, সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।