বিশ্বে মানবিকতার দায় শুধুই বাংলাদেশের
রাখাইনের নরকজীবন থেকে রেহাই পেতে গেল এক মাসে অন্তত সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের শুরু থেকে এ দেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা এখন আট লাখের বেশি। বিশ্ব সংস্থাগুলো দাবি করছে, এ বছরের শেষ নাগাদ আরো কয়েক লাখ নতুন শরণার্থী এদের সঙ্গে যোগ হবে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। পরিবারের পুরুষ মানুষদের হারিয়ে সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে এসব মা পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের অনিশ্চিত জীবনে। নিপীড়ন-নির্যাতনে পর্যুদস্ত উদ্বাস্তু এই মানুষের কাছে মানবিক বাংলাদেশটাই বেঁচে থাকার শেষ ঠিকানা।
হয়তো এখানে মিলছে না পর্যাপ্ত খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা বা বাসস্থান। তবু উখিয়ার সবুজারণ্যে মগদের মতো করে কেউ যখন-তখন কচুকাটা করতে আসছে না। বর্বর বার্মিজ সেনাসদস্যের মতো করে গুলি করছে না বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারছে না তাদের।
এবারে আসা শরণার্থীদের মধ্যে অন্তত এক হাজার ১০০ শিশুই অভিভাবক বা পিতৃমাতৃহীন। এদের কারো কারো চোখের সামনেই নৃশংসভাবে ওদের মা-বাবাকে হত্যা করেছে বার্মিজ আর্মি বা রাখাইন মগরা। উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এখন শিশুদের অভয়ারণ্য। এখনো অন্তত ১৮ হাজার নারী অন্তঃসত্ত্বা। প্রতিদিন ৮-১০ জন করে নতুন শিশু বড় স্বার্থপর এই পৃথিবীতে নাম লেখাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই শিশুদের ভাগ্য লিখন কী হবে, তা কেউ জানে না।
রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন বা আলজাজিরাসহ বিশ্বের সব জনপ্রিয় মিডিয়াতেই রোহিঙ্গাদের দুর্দশার খবর আসছে। জাতিসংঘ বা ওআইসির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা, রাষ্ট্রনায়ক, মানবাধিকারকর্মী, নোবেল লরিয়েটসহ অনেকেই মর্মবেদনায় জর্জরিতও হচ্ছেন। কিন্তু মিয়ানমারকে কেউ বাগে আনতে পারছে না। কারণ তার আছে চীন, রাশিয়া বা ভারতের মতো স্বার্থান্ধ বন্ধু। সবাই প্রমাণসাপেক্ষভাবেই বিশ্বাস করছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন, গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো দেদার ঘটছে। তাও আবার গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির মতো নেত্রী ও তার সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং-এর নেতৃত্বে। যদিও তাঁরা রীতিমতো ভাষণ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের কথা বেমালুম অস্বীকার করে চলেছেন। কিন্তু কেউই এখন পর্যন্ত মিয়ানমারকে চাপে রাখতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
বাংলাদেশ যখন একাই আট লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বইছে, এমন একটা পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ৭৩তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো। এই অধিবেশনের বিভিন্ন ফোরামের আলোচনায় রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ইস্যুটি একটি বড় অংশজুড়ে থাকলেও রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ, বার্মা থেকে শরণার্থীদের ঢল থামানো বা বাংলাদেশে চলে আসা প্রায় মিলিয়নসংখ্যক রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। এর একটাই কারণ রাখাইন তথা বার্মিজ বাণিজ্যের ভাগাভাগি নিয়ে বিশ্বমোড়লরা সবাই দ্বিধাবিভক্ত। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কোনো একটি সিদ্ধান্তে একমত হতে পারে না। অস্ত্র বিক্রি, গ্যাস ক্রয়সহ ইত্যাকার নানা বার্মিজ বাণিজ্যের কাছে মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো পাত্তা নেই। রাশিয়া আর চীনের বিপরীতে গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মার্কিনিরা রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলাকে ‘ভয়াবহ বর্বরতা’ হিসেবে অভিহিত করে সহিংসতা বন্ধ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে। এভাবে তারা রোহিঙ্গা অধিকারের পক্ষে যাও বা খানিকটা রাও শব্দ করছে, তা বার্মিজ দানবদের সামান্যও টলাতে পারছে না। রোহিঙ্গারা মুসলিম হলেও বার্মার বিরুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোরও সরব প্রতিবাদ নেই, তাদের গলাও বড় মিনমিনে। রাশিয়া বা চীনকে চটাবে এমন সাহস মুসলিম বিশ্বের নেই, কারণ তারা নিজেরাই অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে জর্জরিত।
এমন এক দয়ামায়া ও ভালোবাসাহীন বিশ্বসমাজে মানবিকতার একমাত্র দায় বাংলাদেশের। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা কিঞ্চিৎ হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। এতে বাংলাদেশ নানামুখী ঝুঁকিতে পড়ছে। আজীবন নিষ্পেষিত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের অনেকেই এইডস, সোয়াইন ফ্লু, যক্ষ্মা বা অন্যান্য মরণঘাতী ব্যাধিতে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে রয়েছে অধিক বাচ্চা উৎপাদনের সেকেলে প্রবণতা। এই বিপুল মানুষের এমনতর নানা সংকট কতটা সামলাতে পারবে উন্নয়নশীল বাংলাদেশ?
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, অব্যাহত শরণার্থী সংকটে বাংলাদেশ অচিরেই মানবিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তরাষ্ট্রীয় ঝুঁকিতে পড়তে পারে। মাদক ব্যবসায়ী, মানব পাচারকারী, জঙ্গিগোষ্ঠীর শকুন চোখ এখন বিপন্ন রোহিঙ্গাদের ওপর। গোয়েন্দারা যদিও কাজ করে যাচ্ছে, তবুও লাখো মানুষের সবার মতিগতি ঠাওর করতে পারাটা জটিল কর্মযজ্ঞ বটে। এত মানুষকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সমন্বয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা নিজেদের দেশপ্রেমের জায়গা থেকে সবকূল রক্ষা করেই নিশ্চয় অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। উদার ও মানবিক বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও রক্ষা করবে।
কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান ছাড়া এতদাঞ্চলের স্থিতিশীলতা ফেরানো সম্ভব নয়। মানবাধিকার রক্ষা ও বহুজাতির শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে চাইলে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত পাঁচ দফা প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন ছাড়া এ মুহূর্তে অন্য কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে পাঁচ দফা প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে : রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধন অবিলম্বে ও চিরতরে নিঃশর্তে বন্ধ করা, জাতিসংঘ মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ, মিয়ানমারের ভেতরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘সুরক্ষা বলয়’ প্রতিষ্ঠা, বিতাড়িত সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিজ বাসগৃহে পুনর্বাসন ও কফি আনান কমিশনের সুপারিশের ‘নিঃশর্ত, পূর্ণাঙ্গ ও দ্রুত’ বাস্তবায়ন। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও তাঁর সাধ্যের সবটুকু করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার মতিভ্রম কীভাবে ফেরাবেন এ কথা কেউ জানে না ।
রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন সাত সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক গণ-আদালত। ১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি, বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিল ও সাক্ষ্য গ্রহণের ভিত্তিতে এই রায় দেওয়া হয়। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারসের সাবেক প্রেসিডেন্ট আর্জেন্টিনার দানিয়েল ফিয়েরেস্তেইন ওই বিচারক প্যানেলের সভাপতি ছিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে দেওয়া এই রায়ে ১৭টি সুপারিশ করা হয়েছে। এতে মিয়ানমারের ওপর অবিলম্বে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিয়ানমারের সরকারি পদে থাকা ব্যক্তিদের বিদেশে থাকা ব্যাংক হিসাব বাজেয়াপ্ত, মিয়ানমারের বাইরে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
হতে পারে গণ-আদালতের রায় মানার ক্ষেত্রে বার্মিজ আর্মির বাধ্যবাধকতা শূন্যের কোঠায়, তবু নৈতিকভাবে বার্মা এখন একটি অপরাধপ্রবণ রাষ্ট্র হিসেবেই সাব্যস্ত হয়েছে।
এমন এক পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি বিদেশি মিডিয়াকে বলেছেন, কিছু শরণার্থীকে ফেরত আনার জন্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করতে তিনি প্রস্তুত রয়েছেন এবং ‘যেকোনো সময়’ এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। তিনি জেনে বুঝেই এমন কথা বলেছেন; ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বার্মিজ নাগরিক বলেই স্বীকার করা হয়নি। ওদের ভাষায় রোহিঙ্গারা নাকি অভিবাসী বাঙালি। তাহলে কোন শরণার্থী তিনি আসলে ফিরিয়ে নিতে চান? এই একটি কথা থেকেই ধরে নেওয়া যায়, রোহিঙ্গা সংকটের আশু সমাধান হচ্ছে না। পর্যবেক্ষকদের বিবেচনায়, যতক্ষণ পর্যন্ত রাশিয়া, চীন ও ভারতের মতো শক্তির সঙ্গে বার্মার নীতিবিবর্জিত সম্পর্ক চলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীর দায়দায়িত্ব আমাদেরই বহন করে যেতে হবে। বাঙালির পক্ষে হুট করে নিষ্ঠুর মগ বা নির্মম বার্মিজ আর্মির মানসিকতায় পৌঁছানো সম্ভব নয়।
কাজেই বিশ্ব নেতাদের মতানৈক্যের কারণে রোহিঙ্গা প্রশ্নে যেহেতু এই মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে না, সেহেতু ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতার মাধ্যমে বিপাকে পড়া রোহিঙ্গাদের খাদ্য, চিকিৎসা, আবাসন সমস্যার মিটানোর পাশাপাশি তাদেরকে কংক্রিট নিবন্ধনের মাধ্যমে ব্যাপক নজরদারিতে রাখাটাই বাংলাদেশের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত।
আমরা পরিবেশ বিপর্যয় মেনে নিয়েও রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়ায় সংরক্ষিত বনের চারহাজার একর ভূমি ছেড়ে দিয়েছি। ওই এলাকার সামাজিক অস্থিতিশীলতা মেনে নিয়েছি। দেশের বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায় তাদের প্রার্থনা উৎসবের খরচ কমিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করবার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের মুসল্লিসমাজ রাস্তায় নেমে টাকা তুলছে। সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে নিজেদের সঞ্চিত অর্থে ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে। গেল একমাসে বাঙালির মানবিকতার ঐকতানে বাজছে মানুষের জন্য ভালোবাসার সুর। বুদ্ধিস্ট সহিংস বার্মা ও নির্বিকার বিশ্বের বিপরীতে এই বাংলাদেশ এখন অহিংসা ও জীবনবাদিতার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।