শরণার্থী
হতভাগা মায়ের আর্তনাদ শুনবে কে
চোখের সামনে স্বামীকে হাত-পা বেঁধে নৃশংসভাবে হত্যা করে মিয়ানমারের সেনারা। আগুনে পুড়ে নির্মমভাবে হত্যা করে আদরের চার সন্তানকেও। জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি আর বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকুও।
কোলের ছোট্ট শিশুটিকেও কেড়ে নেয় তারা। হাত-পা বেঁধে রাখে শিশুটির। সারা রাত সন্তানের কান্নার শব্দ আমাকে কাঁদিয়েছে। কিন্তু সন্তানকে খাওয়াতে পারিনি বুকের দুধ। পারিনি সন্তানের কান্না থামাতে।
মিয়ানমারের সেনারা রাতভর ধর্ষণ করে আমাকে। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। মরে গেছি ভেবে আমাকে ফেলে চলে যায় তারা। জ্ঞান আসার পর কোনোরকমে উঠে সন্তানকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করি। দেখি, আমার বুকের ধন আদরের সন্তান মাটিতে পড়ে আছে আধমরা হয়ে। শতকষ্টের মাঝেও আঁচলের শেষ ভালোবাসা ছোট্ট শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে নেই।
জীবন বাঁচাতে সন্তানকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকি। কিছুদূর হাঁটার পর হাঁপিয়ে যাই। আর পা চলে না। তারপরও কোনোরকমে ধেয়ে আসি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। সীমান্তে আসার পর বিজিবির সামনে পড়ি। পরে কোনোরকমে গাছের নিচে আশ্রয় নিই। হঠাৎ প্রচুর বৃষ্টি শুরু। কিন্তু কোথায় আশ্রয় নেব, তা আর বুঝে উঠতে পারেনি। ভেজা শরীরে গাছের নিচে কোলের সন্তানকে নিয়ে কোনোরকমে রাতটা কাটাই।
মাঝরাতে কোলে হঠাৎ কেঁদে ওঠে আদরের সন্তান। প্রথমে মনে করলাম, পোকামাকড় বা অন্য কিছু কামড় দিয়েছে কি না? পরে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তাকে বুকের দুধ খাওয়াই। কিছুক্ষণ পর দেখি, বুকের মানিক ঘুমিয়ে পড়েছে। বুঝতে পারিনি, ঘুম থেকে আর উঠবে না, চলে গেছে পৃথিবীর আলো ছেড়ে। বারবার চেষ্টা করি তার ঘুম ভাঙানোর।
শত চেষ্টা করেও আদরের সন্তানের ঘুম ভাঙাতে পারিনি। বুঝলাম, আর নেই বুকের ধন। বুঝতে পারি, চলে গেছে আমার কোল খালি করে। চিৎকার করে শুধু কান্না করেছি। বারবার সন্তানের মুখে চুমু খেয়েছি। দাফনের কাপড় ছাড়া জিরো পয়েন্টের কাদামাটিতে গর্ত করে নিজ হাতে সন্তানকে শেষ কবর দিই। এ কষ্ট, বেদনা, যন্ত্রণা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। চোখের পানি এখন আমার জীবন-মরণ। সব হারালাম। শুধু প্রাণটা আছে আমার। তারপরও দোয়া করি, আল্লাহ যেন স্বামী-সন্তানকে বেহেশত নসিব করেন।
হতভাগা মা আবার চেষ্টা করেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার। এ চেষ্টায় জায়গা হয় উখিয়া ক্যাম্পের পাশে প্লাস্টিকের বসতিতে। পাঁচ দিনে একবেলা খাবারও জোটেনি কপালে। কোনোরকমে পানি খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন হতভাগা মা। আমি জানি না, এই পৃথিবীর ধারণক্ষমতা কতটুকু। তবে জীবনের কষ্ট তার চেয়ে ভারি।
বিশ্ব মানবতা কি পারবে হাজারো মায়ের কান্না থামাতে। পারবে কি মায়ের কোল ভরে দিতে সন্তানের ভালোবাসায়। ফিরিয়ে দিতে পারবে কি লাখো মানুষের জন্মভূমি?
এস এম ফয়েজ, বাংলাভিশন