অভিমত
চাল নিয়ে চাল দিচ্ছে কে?
ভেতো বাঙালি। মাছে-ভাতে বাঙালি। ভাত ছাড়া একদিনও চলে না আমাদের।
‘বেশি করে আলু খান/ ভাতের ওপর চাপ কমান’ এ রকম যত তত্ত্ব কথাই বলা হোক না কেন, দিনে একবেলা হলেও ভাত খেতে হবে আমাদের। নইলে মনে হয় কি যেন খাওয়া হয়নি।
এই ভাতের চাল নিয়ে চলছে দেশে অরাজকতা। বেশ কিছুদিন ধরেই পত্রপত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে চালের বাজারের অস্থিরতা নিয়ে। গত এক দেড় মাসে চালের মূল্য যেভাবে বেড়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার রেকর্ড আছে কি না সন্দেহ।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করেনি। রপ্তানি করার জন্য এক কোটি টনেরও বেশি চাল আছে ভারতের। অথচ একদল অসাধু ব্যবসায়ী টাকা খরচ করে চালের বাজার অস্থিতিশীল করতে ভুয়া চিঠি বানিয়ে বলেছে যে ভারত বাংলাদেশের কাছে চাল রপ্তানি করবে না। স্বাক্ষরবিহীন এই ভুয়া চিঠির ওপর ভিত্তি করে কিছু পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল প্রতিবেদনও তৈরি করেছে।(প্রথম আলো ১৫ সেপ্টেম্বর)
দেশে চালের কোনো সংকট নেই দাবি করে ওইদিন বাণিজ্যমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, অসাধু ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের দোষে চালের দাম বাড়ছে।
খুবই অবাক লাগে, মন্ত্রী মহোদয়রা কত অবলীলায় বলে দিলেন অসাধু ব্যবসায়ী আর সাংবাদিকদের কথা। প্রশ্ন করি, দুজনের কাছেই, সরকার দেশে থাকে কেন? কোনো অনিয়ম যদি ব্যবসায়ীরা করেই থাকে তা হলে তাদের চিহ্নিত করতে বাধা কোথায়? সাংবাদিকরা যদি করেই থাকে ব্যবস্থা নিতে সমস্যা কই?
অবাক হওয়ার বিষয়, মন্ত্রীদের মতোই গত ১৬ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেছেন, চালের মূল্য হঠাৎ করে বৃদ্ধির জন্য একটি গণমাধ্যমের খবরই দায়ী। চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য কোনোক্রমেই চালকলের মালিকরা দায়ী নন। (প্রথম আলো ১৭ সেপ্টেম্বর)
চালের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী ১৪ সেপ্টেম্বর একই সুরে একটি ইংরেজি দৈনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন।
কী বিচিত্র এ দেশ! মন্ত্রী এবং চাল ব্যবসায়ীর সুর এক। একটি দৈনিকের কারণে চালের বাজার অস্থিতিশীল। কী ক্ষমতাধর সংবাদপত্র আর সংবাদকর্মীরা। আর ভুয়া চিঠি তৈরি করে যে চাল ব্যবসায়ীরা করে যাচ্ছেন (বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা যদি সত্য হয়) তাদের টিকিটি ধরতে বাধা কোথায়?
বিনয়ের সঙ্গে মন্ত্রী বাহাদুরের কাছে জানতে চাই, আপনারা অভিযোগ করলেন ব্যবসায়ী আর সাংবাদিকদের কারণে আজকের চালের বাজার অস্থির। কিন্তু আপনাদের কথা হুবুহু কপি করে ব্যবসায়ীরা কীভাবে বলছেন একটি পত্রিকা চালের বাজার অস্থির করে তুলছে? তারা কেন দাম বাড়াচ্ছে যদি পত্রিকার খবর ভুয়াই হয়?
এখন সাধারণ মানুষের মনে কি প্রশ্ন জাগতে পারে না যে, আপনাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের যোগসূত্র আছে? আপনাদের মৌন সমর্থন আছে বলেই ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ালেও কিছু বলছেন না আপনারা? তা না হলে কীভাবে মোটা চাল থেকে শুরু করে চিকন চালের দাম এক মাসে ১০ থেকে ১৫ টাকা বাড়াতে পারে ব্যবসায়ীরা?
আপনারা কোথাও কোনো অন্যায় হলে যদি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেন, তা হলে কেন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো জরিমানা করা ছাড়া বড় ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। আর কোনো ইংরেজি দৈনিক যদি ভুল খবর প্রকাশই করে থাকে তা হলে কেন সেই পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? যেহেতু যশোর বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার শওকত হোসেন স্বীকার করেছেন ‘ বাংলাদেশে চাল রপ্তানিতে ভারত সরকারের সাময়িক নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত কোনো চিঠি বেনাপোলে কাস্টম হাউসে আসেনি। এমনকি ভারতের পেট্রাপোলেও এ বিষয়ে কোনো চিঠি আসেনি। প্রতিদিনই স্বাভাবিক গতিতেই চাল আমদানি হচ্ছে।’ (প্রথম আলো ১৫ সেপ্টেম্বর)
এই স্বীকারোক্তির পরে তো আর কোনো সন্দেহ থাকার কারণ থাকতে পারে না যে, পত্রিকা ভুল তথ্য দিয়েছে। তা হলে সরকার কেন চুপ? ঢালাওভাবে সব সাংবাদিকের ওপর দোষ না চাপিয়ে নির্দিষ্ট পত্রিকাকে ধরেন। আর দয়া করে যে ব্যবসায়ীরা সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে তাদের ধরেন।
আপনাদের সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ী তাল মিলিয়ে কথা বলছেন তারাই যে এই চালের বাজার অস্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত কি না, সেই বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে নিতে ব্যবসা যা করার তা কিন্তু করে নিচ্ছে সুযোগসন্ধানীরা।
মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে বিনীত অনুরোধ শুধু কথা না বলে দ্রুত ব্যবস্থা নিন অপরাধীদের বিরুদ্ধে।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।