বাতাসে আজ লাশের গন্ধ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকবাহিনীর চালানো নির্মম-নির্দয় নির্যাতনের চিত্র কবিতায় তুলে ধরে ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তাঁর বিখ্যাত কবিতা, ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই/আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি/ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে/এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?/বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে।’
সেই একই চিত্র আজ মিয়ানমারের রাখাইনে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের লাশের গন্ধ ভেসে আসছে বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসেও। নাফ নদে লাশের স্রোত। গত ২৯ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরে ২৩টি নৌকাডুবির ঘটনায় আজ সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ১১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৫৭টি, নারী ৩২ জন ও পুরুষ ২৩ জন।
মগের মুল্লুকে যা হচ্ছে তা নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। গলা কেটে হত্যা, পিষে হত্যা, ধর্ষণের পর খুঁচিয়ে হত্যা, নারী-পুরুষকে উলঙ্গ করে গাছে বেঁধে হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, টুকরো টুকরো করে হত্যা। শুধু হত্যা করেই মগরা ক্ষান্ত হচ্ছে না। লাশের চামড়া তুলে উল্লাসের দৃশ্যও প্রযুক্তির কল্যাণে দেখছে বিশ্ববাসী। কিন্তু কারো কিছুই করার নেই। নির্দয় মগ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ঠান্ডা মাথায় খুন বিশ্বকে কাঁদাচ্ছে। তাই তো নিজেদের ধনসম্পদ সব ছেড়ে জীবন বাঁচাতে সবাই ছুটছে বাংলাদেশে। পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে, খেয়ে না খেয়ে শত মাইল হেঁটে পাড়ি দিয়ে রাখাইন রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। শত মাইল পাড়ি দিতে গিয়েও পথে পথে মৃত্যুফাঁদ পেরোতে হয়েছে তাদের। পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে এপির একটি ছবিতে। এপির ফটোগ্রাফার দার ইয়াসিনের তোলা ওই ছবিতে মৃত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন এক তরুণী মা হামিদা বেগম। কখনো চুমু দিচ্ছেন। কখনো সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছেন। পোড়া লাশের গন্ধ পেরিয়ে, চোখের সামনে স্বজনদের গলা কাটতে দেখেও হামিদা আশায় বেঁচেছিলেন।
নাড়িছেঁড়া ধনকে বাঁচাতে সব ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। পথে পথে হাজারো বাধা টপকিয়েছেন সাহসের সঙ্গে। চোখে-মুখে তাঁর স্বপ্ন ছিল নিজ শিশুসন্তানকে বাঁচাতে তো পারছেন। নিঃস্ব হয়ে জন্মস্থান ত্যাগ করলেও আদরের সন্তানের মুখ দেখে সব কষ্ট ভুলে যাবেন। আর এ স্বপ্ন নিয়েই নাফ নদ পাড়ি দিচ্ছিলেন নৌকায়। বাংলাদেশ সীমান্তের মাত্র কয়েক মিটার দূরে নৌকাটি ডুবে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নাফ নদে মিলিয়ে যায় হামিদার স্বপ্নও। কোলের শিশু আবদুর মাকসুদও কোমরসমান পানিতে ডুবে গেছে। যখন পানি থেকে ওঠানো হয়, তখন মাকসুদের নিথর দেহ। শিশুকে কোলে নিয়েই বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন হামিদা। যে শিশুকে কোলে নিয়ে দিনের পর দিন হেঁটে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন, সেই শিশু এখন প্রাণহীন। যেন আকাশ ভেঙে পড়ে হামিদার মাথায়। চিৎকার করে কাঁদছিলেন হামিদা। মাকসুদের লাশের মুখে, কপালে চুমু দিয়ে আদর করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে।
গত ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইনে একসঙ্গে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাক্যাম্পে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরএসএ)। ওই হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্যসহ ৮৯ জন মারা যান বলে মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য। এরপরই রাজ্যটিতে শুরু হয় সেনা অভিযান।
জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেনা অভিযানে এক হাজারের অধিক নিরীহ রোহিঙ্গা মারা গেছেন। আর প্রাণ বাঁচাতে সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে গণধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ করছে। শিশুদের মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলছে জ্বলন্ত আগুনে অথবা নদীতে। আরাকান রাজ্যে মোট পাঁচ উপজেলা। সব উপজেলায় মুসলিম রোহিঙ্গাদের বসতি থাকলেও মন্ড, কুসিডং ও রাসিডং উপজেলায় মুসলিম জনসংখ্যা বেশি। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তারা প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দিয়ে আসছে। কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে সরকার তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যা দিয়ে সব অধিকার হরণ করে নেয়।
মগদের এক ধর্মীয় নেতা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দেওয়ার পর থেকে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়েছে। ওই ধর্মীয় নেতা সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে নিরীহ মুসলমানদের ওপর সন্ত্রাসী কার্যক্রম উসকে দিচ্ছে। আগেও সংঘর্ষ হয়েছে, কিন্তু এমন নির্মমতা কখনো হয়নি। আগে সেনারাই এসে তাদের রক্ষা করত। এখন সেনারাই গুলি করছে, হত্যা করছে। যারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, তারা তিন উপজেলার বাকি ১২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের কী অবস্থায়—তা কেউ জানে না। তারা শুধু বলছে, গ্রামগুলোতে শুধুই রোহিঙ্গাদের লাশের গন্ধ।
সেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের লাশের গন্ধ ভেসে আসছে বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে। নাফ নদে লাশের স্রোত। কয়েক দিন আগে বার্মা-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা মংডুর শাহাব বাজারে একটি লাশের নদীর সন্ধান পায় রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি দল গোপনীয়তার সঙ্গে তাদের গ্রামে যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে ফেলে। দুর্গম পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে সম্মুখে যেতে যেতে একটি নদীর পাড়ে গিয়ে থামে তারা। বাতাসে দুর্গন্ধ ভেসে আসায় নদীর পাড় ধরে এগিয়ে যায় রোহিঙ্গা ওই দলটি। এ সময় নদীর হাঁটুজলে লাশের পর লাশ ভাসতে দেখে ভড়কে যায় তারা ।
প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গা দলটির ভাষ্য, নারী, শিশু ও পুরুষের অগণিত লাশ পড়ে আছে ওই নদীতে। লাশের বিদঘুটে পচা গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। শিয়াল-কুকুরের খাওয়া লাশের হাড়গোড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিলের ধারে ও নদীর পাড়ে। সব লাশই রোহিঙ্গার বলে জানান তাঁরা। তাঁদের ধারণা, পাঁচশর চেয়ে কম হবে না এই লাশের সংখ্যা।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।