অভিমত
রোহিঙ্গারা মরিয়া প্রমাণ করিল
মিয়ানমারের আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যা যুগে যুগেই চলছিল। আগেও সেসব হত্যাকাণ্ডের নির্মম ও বিভৎস কিছু কিছু অস্পষ্ট ছবি ও ভিডিও অবরুদ্ধ আরাকান রাজ্য থেকে বাইরের পৃথিবীতে আসত। কিন্তু সেসব অনেকেই বিশ্বাস করত না। যুগের পর যুগ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত দেশহীন এই রোহিঙ্গারাও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছিল না। এরইমধ্যে নতুন করে তাদের ওপর চালানো হলো জাতিনিধন বা নির্মূল অভিযান। কেন আবার এই নির্মূল অভিযান? সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে নীরিহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক রক্তদানের ঘটনাটি সামনে এনে আলোচনা করা যাক। এবারকার গণহত্যার ঘটনাটি বিশ্ববাসী কেন বিশ্বাস করল, সেই প্রসঙ্গে আগে আসছি।
সাম্প্রতিককালে আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মূল অভিযান চলছে-এই সেদিনও এ কথা কেউ বিশ্বাস করত না। পশ্চিমের দেশ তো দূরের কথা, প্রতিবেশী দেশগুলোও না। অথচ গত কয়েক দশক ধরে সেখানে চলে আসছিল বর্ণনাতীত ‘’নীরব নিধন’’ অভিযান। এখন একসঙ্গে সেই অবরুদ্ধ 'মগরাজ্য' থেকে কয়েক হাজার মানুষের নির্মম মৃত্যু-নির্যাতনের খবর বেরিয়ে এলো একযোগে। এবারের ছবিগুলো ছিল ঝকঝকে, ভিডিওগুলো ছিল ফুল এইচডি মানের। আগে যেখানে মিয়ানমারের সু চি ও জান্তা সরকার ফটোশপ আর ভিডিও এডিটিংয়ের অভিযোগ তুলে হত্যা-নির্যাতনকে বাতিল করে দিত, এবার আর তা হলো না। কেউ আর মিয়ানমারকে বিশ্বাস করল না।
বিশ্বও কবুল করে নিল যে, সত্যিই আরাকানে আবারও রোহিঙ্গা জাতিকে নিধনের চেষ্টা চলছে। সেখানে ‘‘ধরো, মারো আর জ্বালিয়ে দাও’’ পদ্ধতির প্রয়োগ চলছে। হাজার মাইল দূরের আমেরিকা-ইউরোপ নয়; খোদ মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি যে, আরাকানে আবারও গণহত্যা শুরু হয়েছে। কিন্তু লাখে লাখে রোহিঙ্গারা বানের পানির মতো যখন বাংলাদেশে ঢুকল, তখন আর বিশ্বাস না করে উপায় থাকল না।
অথচ আমাদের দেশের স্থানীয় পত্রিকাগুলোও প্রথম দিকে ''রোহিঙ্গা গণহত্যা'' শব্দটি লিখতে ইতস্তত করছিল, তারা শুধু ‘সহিংসতা’ শব্দটি লিখে কাজ সারছিল। কিন্তু জ্বলজ্যান্ত ছবি আর রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষদর্শীরা যখন স্বজন হারানোর হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিল, তারা আর বিশ্বাস না করে পারল না। এসব ছবি আর রোহিঙ্গা শোকগাঁথা মুহূর্তে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। বিশ্ববিবেক ক্ষুব্ধ হলো। জাতিসংঘ এবং ওআইসিও ঘুম থেকে জেগে উঠল। হুংকার ছুড়ল অনিচ্ছুক হোয়াইট হাউসও। অনেকে মনে করছেন, হঠাৎ করে এ রকম বৃহৎ আত্মদানের মধ্য দিয়ে হয়তো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথও খুলে গেল। কিছু অর্জন করতে গেলে যে কিছু বিসর্জন দিতে হয়, তারই উদাহরণ হয়তো এই নারি-শিশুদের বেঘোরে প্রাণবিসর্জন।
বারবার কেন এই জাতিনিধন : রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের গণহারে হত্যা ও দেশান্তরি হতে বাধ্য করার নেপথ্যে যে নীলনকশা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ইতিপূর্বে তৈরি করেছে, সেটিই বর্তমান অং সান সু চি সরকারের মাধ্যমে চূড়ান্ত বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ নীলনকশাটি ইতিমধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। একে একে উন্মোচিত হচ্ছে এর স্বরূপ। অতীতে অবশ্য জাতিগত কারণেই রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারকার পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন।
সীমান্তের ওপার থেকে বিভিন্ন সূত্রে সে বিষয়ে নানা তথ্যও মিলছে এবার। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়াতেও এ সংক্রান্ত বিশ্লেষণমূলক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এসব সূত্রের তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ শুরু হওয়ার পর শিল্পাঞ্চল ও অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সে দেশের সরকার রাখাইন রাজ্যকে বেছে নিয়েছে। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো সুফল আসবে বলে সামরিক জান্তার মদদপুষ্ট কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলের ধারণা। জাতি নিধন বা উচ্ছেদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আরাকানে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার ফাঁকা মাঠ।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটকে অনেকে বলছেন জাতিগত সংঘাত, আবার কেউ বলছেন ধর্মীয় বিদ্বেষ। তবে যে যা-ই বলুক, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বিশাল রাজ্য আরাকান খালি করাটা এ মুহূর্তে জান্তা সরকারের প্রধান লক্ষ্য। প্রয়োজনে নাফ নদে রক্তের স্রোত বয়ে গেলেও সু চির সরকার থামবে বলে মনে হয় না। এ সংকটের পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় দুই কারণই রয়েছে এবং বড় বড় ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড়রা এর সঙ্গে জড়িত। তারা এখন মাঠের খেলা দেখতে প্রস্তুত। খেলা শুরুও হয়ে গেছে। তারা এখন কোমলপানীয় আর পপকর্ন নিয়ে গ্যালারিতে বসে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আরাকানে চীনের বিশাল বিনিয়োগ আছে। বিশেষ করে রাজ্যের উপকূলীয় এলাকায় হাউড্রোকার্বনের বিপুল মজুদের দিকে দৃষ্টি রয়েছে তাদের। মিয়ানমারের সাবেক সেনাশাসক থান সুয়ের নামে প্রচুর সংখ্যক গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। পাশাপাশি আরাকানের উপকূলীয় অঞ্চলে জ্বালানির মূল উপাদান হাউড্রোকার্বন রয়েছে বলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। ২০০৪ সালে রাখাইনে বিপুল জ্বালানি সম্পদের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই সেখানে চীন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায়। পাশাপাশি ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো অনেক দেশ আগ্রহী হয়ে উঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সাল নাগাদ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য পাইপলাইন নির্মাণের কাজও শেষ করে দেশটি।
দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিম উগ্রপন্থা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেও রোহিঙ্গাদের ওপর এমন অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে বলেও মনে করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই এলাকাটি এমনিতেই স্থিতিশীল শান্তিপূর্ণ। এটা উন্নতবিশ্বের অনেক দেশই চায় না। তৃতীয়ত, আসিয়ানের মধ্যে অনৈক্য(মিয়ানমার ও মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে অনৈক্য) তৈরি করারও একটি প্রচেষ্টা এটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে শতাব্দী ধরে চলা এ সংঘাতকে ব্যবহার করেছে আন্তর্জাতিক ক্রিড়নকেরা। এবার সেই সুযোগটি হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
ফলে রোহিঙ্গা সংকটের পেছনে নির্দিষ্ট কয়েকটি অভ্যন্তরীণ কারণ থাকলেও এ ক্ষেত্রে বিদেশি কারণটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে অনেকে মনে করছেন। বিশ্বের কিছু প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতির দেশ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায় মদদ দিয়ে সেসব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরতে চায়। আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিয়ে সার্বভৌমত্বের দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং চাপ তৈরি করতে চায়। সঙ্গে তারা মিয়ানমারের তেল-গ্যাসের মধুও খেতে চায়। এক ঢিলে দুই পাখি মারার সেই মওকাটি এবার দুয়ারে এসে হাজির।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন