আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস
আত্মহত্যার সংবাদ : কেমন হওয়া উচিত
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। আর প্রতিদিন আত্মহত্যার চেষ্টা করে এর প্রায় বিশ গুণ বেশি মানুষ। গবেষণা মতে, প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনাকে প্রতিরোধ করা না গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটিকে অবশ্যই প্রতিরোধ করা যায়। তাই বলা হয়, আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য।
বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে সচেতনতামূলক উদ্যোগ অনেক বেড়েছে কিন্তু সঠিক ও কার্যকরী প্রতিরোধনীতি বা ইফেক্টিভ প্রিভেনশন পলিসি করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ের একটি গবেষণা যার মাধ্যমে তৈরি হবে কার্যকরী নীতিমালা। ভালোবেসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে মুক্তির স্বাদ যারা পেতে চায়, তারা তো আসলে পরাজিত হয় নিজেরই কাছে। কত সংখ্যক মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে, তা হিসাব করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা। তাদের হিসাব মতে বর্তমানে গায়ানা, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় (যথাক্রমে বছরে ৪৪ জন/১০০,০০০, বছরে ৩৮ জন/১০০,০০০, বছরে ২৯/১০০,০০০) আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় আত্মহত্যার প্রবণতা (বছরে ২৯ জন/১০০,০০০) সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে কোনো জাতীয় পর্যায়ের জরিপ না হলেও বিভিন্ন গবেষকের প্রাপ্ত উপাত্ত মতে, এ দেশে প্রতিবছর ১০,০০০ জন মানুষ আত্মহত্যার শিকার। বেশ কয়েকটি ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতিবছর—প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ জন মানুষ আত্মহত্যা ঘটিয়ে থাকে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার সামাজিক আন্দোলনে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে প্রচারমাধ্যমগুলো। ২০০৮ সালে হংকং-এর মিডিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফুকে ডব্লিউ তাঁর এক গবেষণাপত্রে উপস্থাপন করেন যে হংকং-এর চায়নিজ ও ইংরেজি ভাষায় প্রচারিত সংবাদপত্রগুলোতে আত্মহত্যার সংবাদগুলো প্রকাশ না করা বা প্রকাশ করলেও অত্যন্ত কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করায় সে দেশে আত্মহত্যার হার ও প্রবণতা কার্যকরীভাবে কমে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রচারমাধ্যমগুলোর জন্য আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনার একটা সাধারণ গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের দেশে কোনো কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে সহমর্মিতা দেখাতে যেয়ে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তি বা বিষয়কে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করে, আত্মহত্যাকারীকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নায়কোচিত ভূমিকায় রূপান্তর করা হয়। এর ফল হয় ভয়াবহ। আত্মহত্যা করলে ‘মৃত আমি’ অনেক সহমর্মিতা পাব যা অনেকটা সামাজিক ন্যায়বিচারের বিকল্প হবে, এই বোধে ঘটতে পারে আরো নতুন আত্মহত্যা।
বাংলাদেশে কিছু সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনাকে সঠিকভাবে প্রকাশ ও প্রচার না করায় আমরা দেখি সেটি প্রকাশের পরপরই আরো কয়েকটি লাগাতার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। ‘পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহত্যা’—এ ধরনের শিরোনাম পরের বছরের পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রটিকে উপায় বাতলে দেয়, পরীক্ষায় ফেল করলে কী করতে হবে।
অবশ্য কেবল সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা পরিবর্তন করে নয়- পাঠক ও দর্শক রুচিরও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আত্মহত্যার খবরগুলো পাঠক পড়তে চায়-দেখতে চায় বলেই বোধহয় প্রচারমাধ্যমগুলো সেগুলো পাঠকদের পড়ায়- দেখায়। পাঠকের বা দর্শকের এদিক থেকে পরিবর্তিত হতে হবে, সবার স্বার্থে।
খেয়াল রাখতে হবে যে একটি আত্মহত্যার ঘটনাকে ‘নিউজ’ থেকে ‘স্টোরি’তে রূপান্তর করতে যেয়ে আরো নতুন করে আত্মহত্যার তালিকা যেন বেড়ে না যায়। আশার কথা এই যে আমাদের দেশের বেশ কিছু পত্রিকা ও নিউজ চ্যানেল বিষয়টি সম্পর্কে খুবই সচেতন এবং যথেষ্ট সংবেদনশীলতার সঙ্গে আত্মহত্যার খবর পরিবেশন করে। কিন্তু তারপরও বিষয়টি নিয়ে সংবাদকর্মীদের একটি সাধারণ নীতিমালা মেনে চলা উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন যৌথভাবে আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশন বিষয়ে সংবাদকর্মীদের জন্য একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো আমরা সেটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারব না কিন্তু আমাদের নিজেদের মতো করে সেটাকে যতটুকু পারি মেনে চললে প্রতিরোধ করা যাবে অনেক আত্মহত্যার ঘটনা।
সেই গাইডলাইন অনুযায়ী প্রথমেই আত্মহত্যা বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারমাধ্যমগুলোকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার কথা বলা হয়েছে। আত্মহত্যার সংবাদটি প্রথম পৃষ্ঠায় বা অন্যত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রকাশ করা যাবে না। সংবাদটির শিরোনামে এমন কোনো শব্দ বা বাক্যরীতি ব্যবহার করা উচিত নয় যা পাঠক বা দর্শককে উদ্দীপনার খোরাক দেয়। আবার এমনভাবেও প্রকাশ করা যাবে না যে আত্মহত্যা একটি মামুলি স্বাভাবিক মৃত্যুমাত্র, অর্থাৎ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শব্দ বাছাই করতে হবে। যেমন ‘অপমান সইতে না পেরে রেললাইনে মাথা পেতে দিল অমুক’ বা ‘অভিমান করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অমুক’ ইত্যাদি আলংকারিক বাক্যরীতির চেয়ে কেবল সংক্ষিপ্ত শিরোনাম দেওয়া উচিত ‘অমুকের আত্মহত্যা’। শিরোনামে যেন এমন কোনো বার্তা না থাকে, যাতে মনে হয় আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান। ‘ঋণ থেকে চিরমুক্তি পেল অমুক’ বা ‘প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তরুণের বিষপান’ ইত্যাদি শিরোনাম যেন না হয়।
আত্মহত্যার খবরটিকে নিয়ে পরপর ফলোআপ ‘স্টোরি’ করার কোনো প্রযোজন নেই। কীভাবে একজন আত্মহত্যা করেছে বা করার চেষ্টা করে কেন ব্যর্থ হয়েছে সে বিষয়গুলো যেন বিস্তারিত বিবরণ আত্মহত্যার সংবাদে না থাকে। এ ধরনের বিবরণ ভবিষ্যতে আরো একজনকে একটি ‘সফল’ আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে। পাশাপাশি আত্মহত্যার স্থান নিয়ে যেন কোনো সংবাদ না থাকে- যেমন কোনো বিশেষ উঁচু স্থান, বিশেষ পুকুর ইত্যাদিতে প্রায়ই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বলে প্রচারমাধ্যমে সাধারণের জন্য সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না। তবে স্থানটিকে নিরাপদ রাখতে প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষকে আলাদা করে জানানো যেতে পারে। আত্মহত্যাকারীর ছবি প্রকাশ না করাই শ্রেয় আর আত্মহত্যার পরে মৃতদেহের ছবি বা ভিডিও ফুটেজ কোনোভাবেই প্রকাশ করা উচিত নয়। সেলিব্রিটি বা বিখ্যাত বা জনপ্রিয় কেউ আত্মহত্যা করে ফেললে বিষয়টি নিয়ে দ্বিগুণ সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। আত্মহত্যাকারীর পরিবারের নিকটজনদের শোকের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে- এমন কোনো শব্দ বা তথ্য দেওয়া যাবে না যাতে নিকটজনদের শোক আরো ঘণীভূত হয় এবং তাদের মধ্যেও আবার আত্মহত্যার ইচ্ছা জেগে ওঠে। পাশাপাশি আত্মহত্যার প্রতিটি সংবাদের সঙ্গে এমন কিছু তথ্য সরবরাহ করতে হবে যেখানে উল্লেখ থাকবে যে আত্মহত্যার চিন্তা বা ইচ্ছা করলে একজন মানুষ কোথায় সাহায্য পেতে পারে।
প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের পাশাপাশি বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। এখানেও কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবেনা। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। চলচ্চিত্রকার, নাট্যনির্মাতা এমনকি গল্প-উপন্যাস যাঁরা লেখেন তাঁদেরও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে- ইতিবাচকভাবে, আত্মহত্যা প্রতিরোধে তাঁদের সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের যাপিতজীবনের সবটাই সাফল্যে ভরা নয়—আছে ব্যর্থতা, আছে হতাশা। কিন্তু সব কিছুর পরও জীবনই পরম সত্য। এই সত্যকে ধারণ করে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধ নীতিমালা তৈরি করতে হবে আমাদেরই, আমাদের মতো করে, আমাদের জন্য।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট