অভিমত
রোহিঙ্গা সমস্যা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
দীর্ঘদিন থেকেই রোহিঙ্গা সমস্যাটি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ মুহূর্তে যতগুলো রাজনৈতিক টানাপড়েন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কূটনৈতিক জটিলতা ও তৎপরতা বিদ্যমান আছে সেগুলোর মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশেষভাবে স্পর্শকাতর। এ সমস্যাটি শুধু জাতীয় নয়, জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক গণ্ডি পেরিয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সংকটে রূপ নিয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যু। ক্রমেই এ সমস্যা আন্তর্জাতিক মহলকে ভাবিয়ে তুলছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার মুখে বাধ্য হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। ৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইনে নির্যাতনের মুখে গত ২৫ অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে দুই লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়, আগে থেকেই চার লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের ওপর অতিরিক্ত এই জনগোষ্ঠীর চাপ খুব বেশি হয়ে পড়েছে। যেকোনো দেশের জন্যই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা খুব সহজ নয়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য শিগগির সাত কোটি ৭০ লাখ ডলারের প্রয়োজন পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অবশ্য এরই মধ্যে জানা গেছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো তিন লাখ শরণার্থী ধরে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাদের থাকার ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীর মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোও আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
উল্লেখ্য, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও নিপীড়ন বন্ধে উদ্যোগ নিতে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির ১৫৭ জন এমপি। রোহিঙ্গাদের সমর্থনে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য গঠিত সর্বদলীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও লেবার পার্টির এমপি রুশনারা আলীর নেতৃত্বে পার্লামেন্ট সদস্যরা লিখিত চিঠিতে বলেন, ‘জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন ও রোহিঙ্গা সংগঠনের প্রতিবেদনে ভিত্তিতে আমরা মিয়ানমারের ইতিহাসে জঘন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করছি।’ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘চার শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মিয়ানমার সরকার স্বীকার করেছে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য রোহিঙ্গা সূত্রগুলোর মতে, এই সংখ্যা দুই থেকে তিন হাজার হতে পারে।’ রোহিঙ্গাবিষয়ক ইউরোপীয় সংস্থা জানায়, গত কয়েক দিনে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সৈন্যদের আক্রমণে প্রায় তিন হাজার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। এসব দাপ্তরিক তথ্য থেকে আমরা ধারণা করতে পারি, কী পরিমাণ সহিংসতা ও নির্যাতন চলছে রোহিঙ্গাদের ওপর। আর এই ইস্যুটি কেনই বা আন্তর্জাতিক সংকটে পরিণত হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার সরকার দেশি-বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতায় নিজেদের শক্তি সামর্থ্য বাড়িয়েছে। বিশেষ করে গত বছর যুক্তরাজ্য তিন লাখ পাঁচ হাজার পাউন্ড খরচ করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ব্যয় বাবদ। যুক্তরাজ্য মূলত মিয়ানমারের সেনাদের গণতন্ত্র, নেতৃত্ব ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ভেতরে ও বাইরে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ছয় কোটি ৩০ লাখ ডলার দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে বিশ্বের এসব সাহায্যকারী দেশ রীতিমতো উদ্বিগ্ন ও হতাশ হয়েছে। এমনকি রোহিঙ্গাদের এই মানবিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের মহানুভবতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ প্রশংসা করছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার মূলত দুটি দিক আছে। একটি মানবিক, অপরটি জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট। রোহিঙ্গারা যে নিজ দেশে জাতিগত নিপীড়নের শিকার, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে, বিতাড়ন করেনি। কিন্তু শরণার্থীদের সামগ্রিক বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে দেখভাল করার ন্যায্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটের ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে গভীর ষড়যন্ত্র হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে যথেষ্ট। সারা বিশ্বের কাছে এটি পরিষ্কার যে, মিয়ানমার খনিজ সম্পদে ভরপুর একটি দেশ। ভৌগোলিকভাবেও এই দেশটি পরাশক্তির স্বার্থের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার প্রায় পুরোপুরি চীনের ছত্রছায়ায় এবং চীনের প্রত্যক্ষ মদদে পরিচালিত হচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গেও তারা যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে। চীন ও রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ায় মিয়ানমার ‘ডোন্ট কেয়ার’ স্টাইল অবলম্বন করছে। চীন ও রাশিয়া তাদের হাতে থাকলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো প্রস্তাবই জাতিসংঘে টিকবে না-এমন আত্মবিশ্বাসটাও তাদের রয়েছে। মিয়ানমারে এত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটার পরও পাকিস্তান সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ভারতের অবস্থানও পরিষ্কার নয়। এভাবে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসমূহ পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থায় গেলে ক্রমেই এই ইস্যুটি আরো ঘোলাটে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এই মুহূর্তে জাতিসংঘ যদি কোনো জোরালো পদক্ষেপ নিতে না পারে তাহলে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্যাতন কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে তা আন্দাজ করা মুশকিল। কূটনৈতিক সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, অতীতের মতো এবারও বিশ্বসম্প্রদায় ও প্রভাবশালী দেশগুলো বিভক্ত নিজ নিজ স্বার্থে। এ কারণে মিয়ানমারে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, এমনকি গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের মতো ভয়াবহ অভিযোগ সত্ত্বেও তারা একে অগ্রাহ্য করছে।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শুরুর আগেই বিমসটেক ও আসিয়ানের বৈঠক আয়োজনের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর আঞ্চলিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। জাতিসংঘের সমর্থন নিয়ে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখা এখন সময়ের দাবি। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করা। আর এ সমাধান মিয়ানমারের ভেতরেই হওয়া আবশ্যক। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার প্রভাব বাংলাদেশের ওপর ব্যাপকভাবে পড়ায় এ সংকটের সঙ্গে এ দেশও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। কাজেই রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধান করতে না পারলে আন্তর্জাতিক বিশ্বও ক্রমেই হুমকির মুখোমুখি হয়ে উঠবে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।