বাঁকা চোখে
কবির নসিহত ও নিখিল বঙ্গ মুচি সম্প্রদায়
নিজের পায়ে জুতো থাকুক বা না থাকুক বাংলাদেশিরা বিদেশিদের জুতো পালিশে খুবই ওস্তাদ। যাঁরা বিদেশে যান তাঁরা আর কোনো কাজকর্ম করেন না। শুধু জুতো পালিশের কাজ করেন। এতে আয় রোজগার ভালো হয়। মন দিয়ে কাজটা করতে পারলে কামাইটা অনেক বেড়ে যায়। কাড়ি কাড়ি ডলার, পাউন্ড, দিনার, রিয়াল, রুবল ঝুরঝুর করে পকেটে পড়তে থাকে। এই কামাই রোজগার বাদ দিয়ে যদি তাঁরা দেশের জন্য ‘মায়াকান্না’ করেন তাহলে জুতো পালিশে ব্যাঘাত ঘটে। আয় রোজগারে টান পড়ে। এটি ভালো কথা না। ভারি মন্দ কথা। এসব কথা না যায় বলা; না যায় শোনা।
জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিলগুলো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে যেভাবে পাখা মেলে ধরে চক্কর খেয়ে বেড়ায়; হুবহু সেই কায়দায় বাঙালি জাতির সামনে এই অভূতপূর্ব তত্ত্বের সোনালি ডানা মেলে ধরেছেন সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া কবি আবু হাসান শাহরিয়ার। গত ৩ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে এই কবি তাঁর সেই অমর বাণী ফেসবুকে খোলামেলাভাবে মেলে ধরেছেন।
প্রবাসীদের উদ্দেশে কবি লিখেছেন, ‘বাপু হে, ইন্টারনেটের যুগে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। প্রবাসে বসে বাঙালকে হাইকোর্ট চিনিয়ো না। কথায় কথায় রেমিট্যান্সের গল্প কেন শোনাও? বিদেশিদের জুতোপালিশ করতে গেছ; সেই কাজটাই মন দিয়ে করো। আয়-উপার্জন আরো বেশি হবে। ওই উদ্দেশেই তো স্বদেশের মায়া ত্যাগ করেছ। তবে আর দেশের জন্য মায়াকান্না কেন?’
আবু হাসান শাহরিয়ার শুধু যে একজন কবি তা-ই নয়; তিনি একজন সিনিয়র সাংবাদিকও। অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও তিনি দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বলা হয়ে থাকে, কবিরা সত্যদ্রষ্টা হন। আর দায়িত্বশীল সাংবাদিকের কথাবার্তা তো আর ‘আবদুল মার্কা’ কথা না; তাঁরা যা বলেন তা দায়িত্ব নিয়ে বলেন। সেই জায়গা থেকে সত্যদ্রষ্টা শাহরিয়ার একটি স্ব-উপলব্ধিজাত তত্ত্ব হাজির করেছেন। এই তত্ত্ব এক কথায় হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এখন কথা হলো, যে লোকটা বইতে পারে পাঁচ সের; তাঁর মাথায় যদি আড়াই মণের চিড়ার বস্তা তুলে দেওয়া হয় তা নিয়ে সে হাঁটবে কেমন করে? প্রবাসীদের দশাও হয়েছে তাই। কবির ভাষায় তাঁরা বিদেশে মুচিগিরি করেন; দেশে থাকা মা-বাবার খোঁজখবর পর্যন্ত নেন না। কবিতার মতো সুকুমার শিল্প চর্চা করার তো প্রশ্নই ওঠে না। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের মতো এমন ওজনদার জিনিস ছিনিয়ে আনা একজন কবির মর্মকথার মর্তবা এসব মুর্খমগজ বুঝতে পারবে না সে তো জানা কথা। হয়েছেও তাই।
প্রবাসে থাকা ‘নিখিল বঙ্গ মুচি সম্প্রদায়’ কবির আলোচ্য স্ট্যাটাসের কারণে নাখোশ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা ক্ষোভ ঝাড়ছে। অনেকে আজেবাজে কথা বলে এবং লিখে কবির সঙ্গে খানিকটা বেয়াদবিও করে বসেছে। এতে কবিও রেগে কাঁই। তিনি বলে যাচ্ছেন, তিনি সত্যের পথে অটল থাকবেন। তিনি অতি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। তাঁর এক কথা। এসব মুচির সঙ্গে তাঁর কোনো আপস হতে পারে না। এই অনড় অবস্থানের অংশ হিসেবে তিনি কাউকেই ছাড় দিতে রাজি নন। যশোরের কোনো ‘ভেজা বেড়াল তরুণ’ একদা ইভ টিজিং করতে গিয়ে ঝাড়ুপেটা খেয়ে রাজধানীতে এসে কবি হয়ে বসেছেন সে ইতিহাসও তিনি রাগের চোটে কালের গলিত গর্ভ থেকে তুলে এনে ফেসবুকে অ্যাটাস করে দিয়েছেন। কবির বন্ধু তালিকায় থাকা যেসব শুভানুধ্যায়ী তাঁকে শান্ত হতে বলেছেন তিনি অপর এক স্ট্যাটাসে তাঁদের ‘স্বতঃপ্রণোদিত উপদেশ-দাতাগোষ্ঠী’ হিসেবে উল্লেখ করে তাঁদেরও এক হাত নিয়েছেন।
যাঁরা বিদেশে জুতো পালিশ করেন তাঁদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া কোনোভাবেই থামছে না দেখে ৮ সেপ্টেম্বর কবি এক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘কাউকে যদি তার কাজ ‘মন দিয়ে’ করতে বলা হয়, সেই কাজ বা তার পেশাকে কীভাবে ছোট করা হলো, ছোটো মাথায় ঢুকছে না। মাথায় বড়রা বুঝিয়ে দেবেন কি?’
অর্থাৎ কবি এখনো তাঁর বাণীতে অনড় আছেন এবং জুতো পালিশের কাজে তিনি প্রবাসীদের আবারও ‘মন দিতে’ বলছেন। এই ‘মন দিতে’ বলাতে যেকোনো পেশাকে খাটো করে দেখা হয় না তা তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি বিনয়ের সাথে নিজেকে ‘ছোটমাথার’ মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এই ‘ছোটমাথা’ থেকে যে কী পরিমাণ বড় বড় আক্রমণাত্মক বুলেট বোমা বের হয় তা তাঁর টাইমলাইনে গেলে বোঝা যাবে।
যদিও জুতো পালিশসংশ্লিষ্ট প্রথমোক্ত স্ট্যাটাসটি এখন আর কবির টাইমলাইনে দেখা যাচ্ছে না। তবে বেয়াদব প্রবাসী মুচিদের অনেকেই স্ক্রিনশট দিয়ে স্ট্যাটাসটির অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে। সেটি এখনো টোপা শেওলার মতো ফেসবুকের এখানে সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে।
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বলেছেন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে রেমিট্যান্স পাঠায় তা ‘খুবই সামান্য’। বলার মতো কিছু নয়।
এ বছরের ৩ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, শীর্ষ প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় ১১ দশমিক ১১ শতাংশ কম এসেছে। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে তেলের দাম কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমেছে। ওই সব দেশেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি থাকেন।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৬ সালের ‘অভিবাসী ও প্রবাসী আয় : সাম্প্রতিক পরিস্থিতি’ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর সব মিলিয়ে এক হাজার ৩৭০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ২০১৫ সালে এক হাজার ৫৩২ কোটি ডলার এসেছিল।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি আছেন। তাঁরা নিয়মিত দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ কমলেও এক বছরের ব্যবধানে শীর্ষ দশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়েছে দুই ধাপ।
গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। গত আগস্ট মাসে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ১৪২ কোটি মার্কিন ডলার। জুলাইয়ে এ আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ১১২ কোটি ডলার। সেই হিসাবে জুলাইয়ের চেয়ে আগস্টে প্রবাসী আয় ৩০ কোটি ডলার বা পৌনে ২৭ শতাংশ বেড়েছে। প্রবাসী আয়-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের কল্পনা—এই দুটি বিষয়কে একটি পরিষ্কার পাত্রে ঢেলে ঘণ্টা খানিক ডলাডলি করার পর বিক্রিয়াঘটিত চারটি যৌগিক বিষয়ের উদ্ভব হয়। সেগুলো হলো :
১. বিদেশে এক কোটি বাংলাদেশি জুতো পালিশের কাজ করেন।
২. জুতো পালিশ করে তাঁরা শুধু ২০১৬ সালেই এক লাখ নয় হাজার ৬০০ কোটি টাকা (এক ডলার= ৮০ টাকা হিসেবে) দেশে পাঠিয়েছেন। মানে মোট বাজেট বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশ টাকা এসেছে জুতোপালিশ থেকে।
৩. এই টাকা আসলে ‘খুবই সামান্য’।
৪. মাত্র এই কটা টাকা পাঠানো যাদের মুরোদ তাদের দেশের জন্য ‘মায়াকান্না’ করা মানায় না। একমাত্র আবু হাসান শাহরিয়ারের মতো কবি বিভিন্ন ছোটকাগজে স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের ছন্দে দেশাত্মবোধক ছড়া লিখে মায়াকান্না করতে পারেন।
প্রবাসী মুচি সম্প্রদায় খালি প্রশ্ন করে : এই যে রাজধানী ঢাকায় রং-বেরঙের লাইট জ্বলে; বড় বড় দালান ওঠে; সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা বড় বড় গাড়ি হাঁকান—এই টাকা কার টাকা? কেমন করে আসে সেই টাকা? এই যে গ্রামের পর গ্রাম ছনের ঘর থেকে টিনের ঘর, সেখান থেকে পাকা ঘরে রূপ নিচ্ছে সেই টাকা কোত্থেকে আসে?
‘নিখিল বঙ্গ মুচি সম্প্রদায়’ এমন একটি মহান তত্ত্বের গূঢ় অর্থ ধরতে পারছে না দেখে আমারই মায়াকান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
অবশ্য প্রথম আলোর প্রতিবেদনের বিষয়ে এই কবির কিঞ্চিৎ বিবমিষা রয়েছে। গত ২৫ আগস্ট পত্রিকাটির প্রথম পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন থাকায় তিনি একটি স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘যে-দৈনিক পত্রিকা সামান্য অর্থের আশায় লাখ-লাখ বন্যাদুর্গত মানুষের খবরসহ কোনো খবরই না ছেপে প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে বিজ্ঞাপন ছাপাতে লজ্জা পায় না এবং যে-পণ্য বণিকদের পকেট ভারী করতে অগণন পাঠকের মুখে প্রচারের লাথি কষতে কুণ্ঠিত হয় না, সেই পত্রিকা ও পণ্যকে বর্জন করুন। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হোন।
“মলাট ওলটালেই মূল পত্রিকা” কী রে? মলাট তোরা এসে উল্টে দিয়ে যা।
এমন দৈনিককে “সংবাদপত্র” না বলে “বিজ্ঞাপনপত্র” বলা এবং এমন পণ্যকে বন্য জন্তু-জানোয়ারের বিষ্ঠা ভাবা উচিত। উভয়কে আবর্জনা স্তূপে নিক্ষেপ করাই হচ্ছে উপযুক্ত জবাব।’
পত্রিকাটিকে তিনি ‘জন্তু জানোয়ারের বিষ্ঠা’ বলেছেন। সেটিকে বর্জন করে জাতিকে ‘আত্ম মর্যাদাবান’ হওয়ারও নসিহত করেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই স্ট্যাটাস দেওয়ার এক সপ্তাহ না যেতেই ৩১ আগস্ট তিনি ধর্ষণ সংক্রান্ত দুটি স্ট্যাটাস দেন। দুটিতেই তিনি প্রথম আলোর রিপোর্টের প্রিন্ট কপি ছেপে দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি তিনি বাসায় এই পত্রিকাটিই রাখেন।
আসলে তিনি কবি মানুষ তো তাই সবকিছু মনে রাখতে পারেন না।