শ্রদ্ধাঞ্জলি
তিনি ছিলেন মহাতারকা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য উদয়ের প্রাক্কালে ১৯৭০ সালে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান রূপকের আশ্রয়ে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনকে উপজীব্য করে ‘জীবন থেকে নেয়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ছবিতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি চিত্রায়িত হয়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি পায় গানটি। দেশাত্মবোধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ সেই ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন আবদুর রাজ্জাক। অমিত অভিনয় প্রতিভা দিয়ে দিন দিন এই রাজ্জাক হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা। বাঙালি তাঁকে ভালোবেসে উপাধি দেয় নায়করাজ। আমাদের আপনজন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ দেহাতীত হলেন বটে, তবে রেখে গেলেন তাঁর শিল্পালোকের বিশাল কর্মসম্ভার। রেখে গেলেন চলচ্চিত্রের এমন প্রদীপ্ত আলোকবর্তিকা, যা বয়ে নিতে বাধ্য আগামীর শিল্পপুরুষেরা। গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রিয় শিল্পী প্রিয় মানুষ নায়করাজ রাজ্জাক।
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন সোমবার সন্ধ্যায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতার টালিগঞ্জে ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজ্জাক জন্মগ্রহণ করেন। রাজ্জাকের জীবনটাই এক বড় চলচ্চিত্রের গল্প। ১৯৬৪ সালে নিজের জন্মভূমিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে কপর্দকশূন্য হয়ে রাজ্জাক তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় পাড়ি জমান। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন। রাজ্জাক বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে তাঁর অতীত রোমন্থন করেছেন সগর্বে, ‘আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি। স্ট্রাগল করেছি। না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনোদিন আসেনি। ওটা আসেনি বলেই আজকে আমি এতদূর শান্তিতে এসেছি।’
৭৬ বছরের দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন রাজ্জাক। জীবনের কঠিন সংগ্রাম তাঁকে পাওনা দিতে ভুল করেনি। পাঁচ দশক ধরে রাজ্জাক মধ্যবিত্ত বাঙালির যাপিত জীবনের গল্প বলে গেছেন। চলচ্চিত্রের অনিন্দ্য শিল্পকথক ছিলেন তিনি। একে একে তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৬টি ছবি পরিচালনা করেছেন। প্রযোজনা করেছেন ২০টি ছবি। এই মহান অভিনয় শিল্পী আজীবন সম্মাননাসহ পাঁচবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পেয়েছেন মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। একমাত্র অভিনেতা হিসেবে পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আমৃত্যু কাজ করেছেন। শিল্পচর্চা ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠ একজন মানুষের প্রয়াণে চলচ্চিত্র পরিবার নিঃসন্দেহে অভিভাবক হারাল। রাজ্জাকের অনুজ শিল্পীরা তাঁদের গুরু সম্পর্কে বিভিন্ন সময় উচ্চারণ করেছেন, তাঁর ছায়া যত দিন থাকবে, চলচ্চিত্রে কোনো অশুভ ছায়া থাকবে না। তাঁর আলোয় এফডিসি আলোকিত থাকে!
চলচ্চিত্র জীবনের শুরুতে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় দিয়ে যাঁর শুরু, তাঁর বেশ কিছু সিনেমাই পরে ক্ল্যাসিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। রাজ্জাক অভিনীত ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘আলোর মিছিল’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’ কিংবা ‘স্বরলপি’ এখনো ভক্ত দর্শকরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সেসব সিনেমার গানগুলো এই প্রজন্মের মানুষরাও সোৎসাহে গায়।
মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন মঞ্চে অভিনয় দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন রাজ্জাক। পরে ৫০টি মঞ্চনাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতাও ছিল তাঁর ঝুলিতে। টেলিভিশন নাটকেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তাঁর অনন্য অভিনয় নিপুণতা দিয়ে ভক্ত, দর্শক ও শ্রোতাদের কাঁদিয়েছেন, হাসিয়েছেন, নানা দুর্বিপাকে জীবনের দিশা দিয়েছেন। এভাবে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। গুণী এই অভিনেতার অভিনয় ও ব্যক্তিগত জীবনের কর্মপরিসর নিশ্চয় অনুপ্রাণিত করবে তাঁর উত্তরপুরুষদের।
এ সময় বাংলা চলচ্চিত্র স্মরণকালের সবচেয়ে দৈন্যদশা অতিক্রম করছে। শিল্পীরা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে একে অপরের বিরুদ্ধে লেগে থাকছে। এফডিসির ভেতরে শিল্পীরা নিজেরাই মারামারি-হাতাহাতিতে লিপ্ত হচ্ছে। তা বাইরে প্রচারও হচ্ছে। রুপালি জগৎ নিয়ে সাধারণ দর্শক যে স্বপ্ন বা উচ্চাশা পোষণ করে, তার ছিটেফোঁটাও এখন আর অবশিষ্ট নেই। কার্যত হলে গিয়ে মানুষ আর সিনেমা দেখায় কোনো আগ্রহ পান না। চলচ্চিত্র জগতের এমন অস্থিরতায় নিয়ে রাজ্জাক তাঁর জীবনের শেষ বেলায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের সিনেমায় এর চেয়েও অনেক কঠিন সময় গেছে। চলচ্চিত্রের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কখনোই এফডিসিপাড়া থেকে ওসব খবর বাইরে যেতে দিইনি। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করেছি। আমাদের সময়কার সমস্যার তুলনায় এখনকার সমস্যা তো কিছুই না!’
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাজ্জাক চলচ্চিত্রের ভাবনায় সময় কাটিয়েছেন। তবে বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্রের বেহাল দশায় তিনি যারপরনাই ব্যথিত ছিলেন। হতাশ হয়েই তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘দেশের সিনেমার এমন অবস্থা হবে কখনোই ভাবিনি। কী এক সংস্কৃতি শুরু হয়েছে!’
বাংলা চলচ্চিত্র পরিবারকে অসীম আকাশ এনে দিয়েছিলেন রাজ্জাক ও তাঁর সতীর্থরা। সেই আকাশের অনেক নক্ষত্রের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি জাগতিক নিয়মে অন্যজগতে পাড়ি দিল। পেছনে রেখে গেল হাজার অর্জনের গল্পগাঁথা। রাজ্জাক আমাদের মনশীলতা বিনির্মাণের পুরোধা ছিলেন। এমন মহান শিল্পীর শারীরিক প্রয়াণ হলেও বাঙালি তাঁর সৃজনশীলতার আদ্যোপান্ত যুগ যুগ রেখে দেবে বুকের গহিনে।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।