অভিমত
ছাত্রসংসদ নির্বাচন কেন নির্বাসনে!
জাতি হিসেবে আমাদের যা কিছু মহত্তম অর্জন তার পেছনে রয়েছে তারুণ্যের অক্লান্ত অবদান। তাদের রক্তে লেখা হয়েছে আমাদের ইতিহাসের সদর দরজাসহ সব অলি-গলি। উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই বলা যায়, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে ১৯৪৮ এর ১১ মার্চ যে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়েছিল তার নেতৃত্ব দিয়েছিল কিন্তু ছাত্ররাই।
সেদিন আব্দুল গনি রোডে অবস্থিত সচিবালয়ের সামনে পিকেটিং করার সময় গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, অলি আহাদ, রণেশ দাস গুপ্তসহ আরো অনেকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সেটাই ছিল যেকোনো দাবিতে প্রথম সফল সর্বাত্মক ধর্মঘট।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে আমরা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম। ১৯৫৬ সালে নিখিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আমাদের মুখের ভাষা বাংলা স্বীকৃতি লাভ করে। তারপর ১৯৬২,৬৬, ৬৯ এবং পরিশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ এমন বাঁকবদলের প্রতিটা মুহূর্তে তরুণ ছাত্র-যুবাদের রয়েছে অসামান্য অবদান।
১৯৬৮ সালে দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ (তখন অবধি বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি তিনি) অন্য আসামিরা যখন কারাবন এবং তাদেরকে ফাঁসি দেওয়ার চক্রান্ত যখন একটু একটু করে বাস্তবায়নের পথে তখন ধীরে ধীরে গণআন্দোলনের পটভূমি রচনা করে সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য করে কিন্তু মূলত ছাত্ররাই।
যে কারণে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, তৎকালীন ছাত্রনেতা এবং ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ (আজকের বাণিজ্য মন্ত্রী) পুরোভাগে থেকে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর তারই নেতৃত্বে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ এ ছাত্রদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে এক গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং সেদিনই তাকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেদিন যদি বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো যেত তাহলে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামটাই হয়তো পণ্ড হয়ে যেত! সেদিন যদি ডাকসুর মতো নেতৃত্ব সৃষ্টিকারী ছাত্র সংসদ না থাকত তাহলে আমাদের ললাটে আজন্ম পরাধীনতার ছাপটাই তাহলে হয়তো লেপ্টে যেত!
সে সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারাই নেতৃত্বে ছিলেন তারাই গণমানুষের চেতনাকে শাণিত করে বাংলা ও বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন।
আবার সে ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এর ২ রা মার্চ স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উড়িয়েছিলেন কিন্তু তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব। আর ৩রা মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন ডাকসু জি এস শাহজাহান সিরাজ। এ সবই হলো স্বাধীনতা পূর্ববর্তী আমাদের ছাত্র নেতৃত্বের সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
আর এখন আমরা এই যে গণতন্ত্রের কথা বলছি, ভোট ও ভাতের অধিকারের কথা বলছি, সুশাসন ও ন্যয্যতার দাবি তুলছি সেটার পেছনে কি ডাকসুসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেদিন যারা ছাত্র সংসদে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের ভূমিকা এতটুকুও কম? ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর (আমাদের বিজয়ের মাসে) যে সামরিক শাসক এরশাদের পতন হয় সেখানে তো সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র আন্দোলনও সবিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
এরশাদ সরকারের পতন হলো গণতন্ত্রে উত্তোরণের লক্ষ্যে কিন্তু কোথা থেকে, কি দিয়ে যেন কি হয়ে গেল!ভাবলে শুধু অবাকই লাগে। গণতন্ত্রে উত্তরণ হলো ঠিকই কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন যেন নির্বাসনে চলে গেল। কারণ প্রায় ২৬ বছর ধরে (৯০-এর পরে আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি ধরে নিলে) সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাধারন ছাত্রছাত্রীদের বৈধ প্রতিনিধি শূন্য হয়ে পড়েছে। আর সেই সাথে গৌরবময় ছাত্র রাজনীতিও দলীয় বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অথচ এটা তো হতে পারে না।
গণতন্ত্র তো একটা প্রক্রিয়া; সহিষ্ণু জীবনবোধ অর্জনের সার্বজনীন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আজ যারা ছাত্র তারাই তো আগামী দিনে দেশকে নেতৃত্ব দিবে এবং গণতন্ত্রকে তারা আরো মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করাবে। তাহলে গণতন্ত্র চর্চার প্রক্রিয়ায় শুরুতেই তো তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তা না করলে কীভাবে হবে! প্রশ্ন হচ্ছে, সে সম্পৃক্তকরণের প্রক্রিয়াটা কী? উত্তর হচ্ছে, সেটাই হলো ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এ কারণে অন্তত গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে চলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
অনেকে ছাত্রদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির কথা তুলে তাদের গালমন্দ করে থাকে। কিন্তু তারা ভাবে না এর জন্য ওদের দায় খুবই সামান্য। কারণ নেতা তৈরির প্রক্রিয়া তো তাদের হাতে নেই। সেটা তো নানা জায়গা হতে নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যক্তি স্বার্থ অর্জনের হাতিয়া্র হিসেবে। ফলে হানাহানি, মারামারি বা চাঁদাবাজির যেসব ঘটনা ঘটছে তার দায়ভার কোনভাবেই গৌরবময় ইতিহাসের অধিকারী ছাত্র রাজনীতির কাঁধে চাপিয়ে দেয়া যক্তিযুক্ত নয় বলেই আমি মনে করি।
ছেলেমেয়েদের সুস্থ, সুন্দর রাজনীতিতে দীক্ষা দিতে এবং ক্যাম্পাসমুখী করতে হলে তাই সবার আগে প্রয়োজন হচ্ছে সাধারণ ছা্ত্রছাত্রীদের কাছে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা হিসেবে ছাত্র সংসদ সবসময়ের জন্য চালু রাখা। ভোটে নির্বাচিত হতে গেলে যে দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করে ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণে কাজ করতে হবে সে শিক্ষা তারা তাহলে সহজেই পেয়ে যেত। আর সেটাই হতো তাহলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শিক্ষার প্রথম শক্তিশালী ধাপ।
গণতান্ত্রিক মুল্যবোধ সৃষ্টি না হলে ক্ষতিটা কী হবে? উত্তর হচ্ছে- দেশ একসময় সত্যিকার অর্থেই ভালোমানের নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হবে। আর দলীয় লেজুড়বৃত্তি বা উপরমহলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যেসব নেতা সৃষ্টি হবে তারা স্বাভাবিকভাবেই নৈতিকতার মানদণ্ডে অত্যন্ত দুর্বল হবে। দুঃখজনকভাবে বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই ধরনের নেতৃত্বই তৈরি হচ্ছে। অধিকাংশ সময় তারা নেতার তুষ্টিতে ব্যস্ত থাকে। তাহলে এমন নেতৃত্ব কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং সুশাসন ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রশ্নে সবল ভূমিকা নিবে?
মহামান্য রাষ্ট্রপতিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে ভাষণ দিতে গিযে ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজনীতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “এ নির্বাচন হতেই হবে, তা না হলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে নেতৃত্বশূ্ন্য হয়ে যাবে।” এটাই হচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার ভয়াবহ পরিণাম!
সেই নেতৃত্বশূন্যতা থেকে দেশকে বাঁচাতে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী করতে চাইলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার তাই কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। বড় রাজনৈতিক দলগুলো, সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যিকার অর্থেই সেটা উপলব্ধি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে দ্রুত সচেষ্ট হবে –সেটাই সবাই প্রত্যাশা করে।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক, সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ