প্রধানমন্ত্রী, মেয়েটির কথা শুনতে পাচ্ছেন?
পরিবার ওর বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। বাঁচার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না আত্মীয়স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীরাও। তা হলে মেয়েটি এখন কোথায় যাবে?
কার কাছে গেলে শকুনের হাত থেকে রেহাই পাবে ? মেয়েটি জানে না। আদালত তাকে রাজশাহী সেফ হোমে পাঠিয়েছে। তার মাকে পাঠানো হয়েছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে।
গত ১৭ জুলাই মেয়েটিকে ধর্ষন করে বগুড়ার শহর শ্রমিক লীগের নেতা তুফান সরকার। পরে ২৮ জুলাই তুফান সরকারের স্ত্রী আশা সরকার এবং বড় বোন নারী কাউন্সিলর এবং তুফানের ক্যাডাররা নির্যাতন চালিয়ে মা-মেয়েকে মাথা ন্যাড়া করে দেয়। এ ঘটনায় মা বাদী হয়ে ওই রাতেই মামলা করেন।
মেয়েটি তার অসহায়ত্বের কথা বলেছে এভাবে ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে বিচার চেয়েছি। বন্দি জীবন চাইনি। এমন জানলে মামলা করতাম না। তার চেয়ে শহর ছেড়ে কোথাও চলে যেতাম। কেউ আমার কষ্ট বুঝত না। এখন আমার পড়াশোনার কী হবে? আমার কলেজে ভর্তির কী হবে? এভাবে সেফ হোমে বেশি দিন রাখলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।
মেয়েটির মা বলেছেন, মেয়েকে ছেড়ে একা থাকতে খুব কষ্ট হবে। মেয়েটা আমার কাছে থাকলে এত কষ্টের মধ্যেও শান্তি পেতাম।’
নিরুপায় হয়ে মেয়েটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে বলেছে, ‘আমাকে বাঁচান। আমি মুক্তভাবে বাঁচতে চাই। পড়াশোনা করতে চাই।’
কতটা অসহায় হলে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি মেয়ে এভাবে বলতে পারে! যখন একে একে তার চারপাশের আলো নিভে যেতে থাকে তখন বুঝি মানুষ এভাবে একটু আলোর জন্য কাতরতা প্রকাশ করে। সমাজ রাষ্ট্র আজ কী অসহায় সেই তুফানদের কাছে?
প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এমন খবর পড়তে হয়। আমরা ভুলে যাই গত সপ্তায় কে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। কোন ঘটনাটা সারা দেশে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সেটাও আর মনে থাকে না। নতুন কোনো ধর্ষণের ঘটনা আমাদের স্মৃতিকে ভুলিয়ে দেয়।
এর আরেকটা বড় কারণ হতে পারে এ রকম, আমরা যখন দেখি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু কোনো ধর্ষণের ঘটনার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হচ্ছে না। আইনের মারপ্যাঁচে বা প্রভাবশালীদের কালো হাতের কারণে ধর্ষক মাফ পেয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের চেতনা আমাদের বোধ ভোতা হয়ে যায়।
আরেকটি বিষয় দেখি, যখন কোনো চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তখন পত্র-পত্রিকা যেমন ফাটিয়ে প্রচার করে তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই নিজেকে বিশাল কিছু ভেবে লেখালেখি শুরু করে। কিন্তু ওই ফেসবুক পর্যন্তই প্রতিবাদ সীমাবদ্ধ থাকে। কাজের কাজ ওই ফেসবুক পর্যন্তই।
এভাবেই আমরা মেনে নেওয়া সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।
বগুড়ার তুফান সরকারি দলে ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে। সে জানে তার কিছু হবে না। বরং ওই মেয়েটির ওপর একসময় নেমে আসবে অমানুষিক নির্যাতন। আর সেই ভয়ে আদালত মা মেয়েকে সেফ হোম আর ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
যে মেয়েটি পড়াশোনা করতে চায়, সেই মেয়েটি কিভাবে সেফ হোমের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে থাকবে? প্রধানমন্ত্রী আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন অসহায় মেয়েটির আর্তনাদ? কতটা অসহায় হলে একটি মেয়ে বলতে পারে- ‘এমন জানলে মামলা করতাম না। তার চেয়ে শহর ছেড়ে কোথাও চলে যেতাম।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো নারী শিক্ষার প্রতি আন্তরিক। আপনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা একে একে তাদের অবদান রেখে চলেছে। ওই মেয়েটি তার ওপর যে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে তার বিচার হয়তো আর চায় না, চায় নিরাপদে থাকতে, চায় পড়াশোনা চালাতে। কারণ সে বুঝে গেছে তাকে যে নির্যাতন করেছে এই সমাজ এই রাষ্ট্র তার বিচার করতে পারবে না। আপনি কি তাকে নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তাটুকু দিতে পারেন না? আপনি না পারলে আর কার কাছে যাবে অসহায় মেয়েটি?
যদি এভাবে ওই মেয়েটিকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সেফ হোমে দিনযাপন করতে হয় তা হলে তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। একসময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেও পারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি ওই অসহায় মেয়েটির কথা শুনতে পাচ্ছেন?
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।