প্রতিক্রিয়া
স্বপ্ন দেখাচ্ছে ইলিশ
ইলিশ (ইংরেজি : Ilish, বৈজ্ঞানিক নাম : Tenualosa ilisha) বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এটি একটি সামুদ্রিক মাছ, যা ডিম পাড়ার জন্য বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীতে আগমন করে। বাঙালিদের কাছে ইলিশ খুব জনপ্রিয়। উপমহাদেশের ২৬ কোটি লোক ইলিশ খায়। তবে বাংলাদেশেই এই মাছ ধরা পড়ে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে পাটের পর দ্বিতীয় নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ইলিশ মাছ। বিশ্ববাজারে এটা এখন বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। গত ৪৫ বছরে এ উদ্যোগ না নেওয়া হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই এই গর্বিত পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দ্বার খুলে গেছে ইলিশকেন্দ্রিক বহু সম্ভাবনার।
বাংলাদেশে প্রতিবছরই বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। মাত্র দেড় দশকের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে দুই লাখ টনের বেশি। ২০০০-০১ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল দুই লাখ ২৯ হাজার ৭১৪ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চার লাখ টনের বেশি ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে দেশে দুই লাখ টনের কম ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে উৎপাদন আরো কমে এক লাখ ৩৩ হাজার ৩২ টনে নেমে আসে। এর পর থেকে জাটকা রা কর্মসূচিতে জোর দেয় সরকার। এতে উৎপাদন কিছুটা বাড়তে থাকে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুই লাখ ৯৮ হাজার ৯২১ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এর পর মা-মাছ রার কর্মসূচি আরো জোরদার করলে ইলিশের উৎপাদন তিন লাখ টন ছাড়িয়ে যায়।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে তিন লাখ ৮৫ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চার লাখ টনের বেশি ইলিশ উৎপাদন হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সে উৎপাদন বেড়ে হয় সাড়ে চার লাখ টন। চলতি বছরে পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর, যার আর্থিক মূল্য হবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু ইলিশের বাজারমূল্যই সবটা নয়, আরো অনেক বিষয়ের গুরুত্বের কথাও এখন আলোচনায় আসছে। এগুলোকে বলা হচ্ছে খাদ্যবহির্ভূত মূল্য (নন-কনজাম্পটিভ ভ্যালু)। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইইডি), বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস) ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ যৌথভাবে ইলিশের খাদ্যবহির্ভূত মূল্য নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। ভারতে ১৫ শতাংশ, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ, আরব সাগর-তীরবর্তী দেশ এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর-তীরবর্তী দেশগুলোয় বাকি ইলিশ ধরা পড়ে। ইলিশ আছে বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে ১০টিতেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে করা ওই গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্য ছাড়াও ইলিশের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জীবিকা সৃষ্টির মূল্য রয়েছে। একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইলিশের এই চারটি বিষয়ের আর্থিক মূল্যমান পরিমাপ করেছে তারা। তাতে এর খাদ্যবহির্ভূত গুরুত্বের মূল্যমান দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এই আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থাগুলো বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে ইলিশ। ভারতে কই মাছের বাজার বা মোট আর্থিক মূল্য সবচেয়ে বেশি হলেও তার বড় অংশ আসে কৃত্রিমভাবে চাষ থেকে। প্রাকৃতিক উৎসের মাছের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইলিশ। শুধু আর্থিক বা খাবার মূল্য নয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও জীবনযাত্রার দিক থেকেও ইলিশ এই উপমহাদেশের সেরা মাছ।
ইলিশের উৎপাদন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে আরো বড় স্বপ্ন দেখা যেতেই পারে। কারণ, গত চার দশকে পদ্মাসহ দেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর নাব্য হ্রাস পাওয়ায় হাজার হাজার মাইল নৌপথ বিলুপ্ত হলেও রুপালি ইলিশের উৎপাদন এ সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। দেশের জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ সময়ে খাদ্য উৎপাদনও দ্বিগুণ হয়েছে। মাত্র দুই দশক আগেও যেখানে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল প্রায় দুই লাখ টন। সরকারি উদ্যোগগুলোর সুফল হিসেবে গত মৌসুমে প্রায় চার লাখ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। এক দশকের বেশি কাল ধরে ইলিশ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি শতকরা প্রায় ১০ ভাগ। প্রায় দুই লাখ জেলের কর্মসংস্থানসহ জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের অবদান প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। দেশের বিপুল চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ইলিশ রপ্তানি থেকে বছরে জিডিপিতে সরাসরি যোগ হচ্ছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা।
ইলিশ মাছ ভারতসহ বিশ্বের আরো অনেক দেশেই উৎপাদিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের জুড়ি মেলা ভার। পদ্মার ইলিশের স্বাদ, গন্ধ ও সৌন্দর্যের কারণেই সারা বিশ্বে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ কারণেই পদ্মার (চাঁদপুর) ইলিশ আমাদের অন্যতম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য। ইলিশের উৎপাদন যতই বাড়ছে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বাজারমূল্যও। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অন্য সব মাছের চেয়ে ইলিশের মূল্য কয়েক গুণ বেশি। জাটকা সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে ইলিশের উৎপাদন যেমন বাড়ছে, সেই সঙ্গে ইলিশের আকার-আকৃতিও বাড়ছে। যদিও সাধারণ মানুষের পক্ষে বড় সাইজের ইলিশ মাছ কেনা অনেকটাই দুঃসাধ্য। জাটকা সংরক্ষণে গৃহীত নানা উদ্যোগের পরও মৌসুমে হাজার হাজার টন জাটকা ধরার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশের প্রজনন সহায়ক উদ্যোগগুলো আরো যথার্থভাবে বাস্তবায়িত হলে বড় ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নামিয়ে আনা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে সমুদ্রপথে ইলিশ পাচার ও অবৈধ চোরাচালান বন্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশে মাছের চাহিদার জোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমাদের মৎস্য উৎপাদকরা বছরে কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের মাছ রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে শতকোটি মানুষের দেশ চীন বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের মাছ বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে। একইভাবে ভারতও বছরে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মাছ রপ্তানি করছে। সেখানে বাংলাদেশে নদ-নদী ও সমুদ্রোপকূলের মৎস্যসম্পদ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলারের মাছ রপ্তানি সম্ভব। মৎস্য সংরক্ষণ ও আহরণের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনার পাশাপাশি উপকূলীয় জেলেদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ নৌ দস্যুতা থেকে রক্ষার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সমুদ্রপথে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ইলিশের চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। জাতীয় মাছ ইলিশের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং ও রপ্তানি বাণিজ্য থেকে যেমন দেশের জন্য আরো হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। একইভাবে নৌ দস্যুতা, ডাকাতি ও চোরাচালান বন্ধের মাধ্যমে ইলিশের স্বাদ সাধারণ মানুষের কাছে আরো সহজলভ্য করা সম্ভব। সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের নিরাপত্তা ও মৎস্যসম্পদ আহরণ নিশ্চিত করতে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর টহল ও নজরদারি আরো জোরদার করা আবশ্যক। ইলিশ ও সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সরকার আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।