মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ
সব কিছুর বিকল্প হয় না
মায়ের সঙ্গে প্রতিটি সন্তানের রয়েছে নিবিড় নৈকট্যে বাঁধা আত্মার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সন্তানের সঙ্গে মায়ের এ সম্পর্ক বস্তুত শুরু হয় মায়ের গর্ভ থেকেই। আবার জন্মের পরেও তেমনি মা-ই তাঁর বুকের দুধ দিয়ে শিশুর শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে থাকেন।
বলা হয়ে থাকে, শিশু জন্মের পর থেকে ছয় মাস অবধি শিশুকে শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোই যথেষ্ট। এ সময় শিশুর জন্য অন্য কোনো বিকল্প খাবার; এমনকি আলাদাভাবে এক ফোঁটা পানিরও প্রয়োজন হয় না। এ কারণেই মায়ের বুকের দুধকে বলা হয়ে থাকে শিশুর জন্য এক অমূল্য সম্পদ। কোনো অবস্থাতেই তাই এ সম্পদ খাওয়া থেকে শিশুকে বঞ্চিত করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।
ইতিহাস বলছে, ১৯৮১ সালের মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিরা মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নিয়ে রেগুলেশন এবং ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর থেকেই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোয় উৎসাহ দিতে এবং শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্যে প্রতিবছর পৃথিবীর ১২০টিরও বেশি দেশে ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালন করা হয়। বাংলাদেশেও ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হয়ে আসছে।
তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে মায়ের বুকের দুধ পান করানোর ব্যাপারে সবাই ঐক্যবদ্ধ হলো, তা অর্জনের ধারেকাছেও কি উন্নত কি অনুন্নত দেশ- কেউই আমরা পৌঁছাতে পারিনি! কারণ, বিশ্বব্যাপী জন্মের পর থেকে ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ৩৭ জন শিশু প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে। ভাবা যায়! যে দুধ পান করার শিশুর জন্মগত অধিকার সে দুধ পরিপূর্ণভাবে প্রথম ছয় মাস পান করতে পারে না ৬৩ শতাংশ শিশু। এ কারণে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল মাতৃদুগ্ধ পানের হার ২০১৬ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার।
সুখের বিষয় হলো, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৫৫ শতাংশ; যা আমরা ২০১৪ সালেই অর্জন করেছি। এটা যদি হয় সুখের খবর, তাহলে দুঃখের খবরটাও একটু বলি তাহলে। সেটা হচ্ছে, আমাদের দেশে ২০১১ সালে সদ্যজাত থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ছিল ৬৪ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে ৯ শতাংশ কমে ৫৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আবার গুঁড়ো দুধ খাওয়ানোর হার বিপজ্জনক হারে বেড়ে চলেছে ( সূত্র : মার্চ ১৬, ২০১৬ দৈনিক জনকণ্ঠ)। তার মানে হচ্ছে, আমাদের দেশে যে হার ছিল ৬৪ শতাংশ, সেটা এখন কমে ৫৫ শতাংশে এসেছে। অর্থাৎ উন্নতির দিকে যাত্রা না হয়ে বরং তা অবনতির চিত্রটাকেই আরো বেগবান করেছে।
এর পেছনে মূলত কয়েকটি কারণ দায়ী। প্রথমত. পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে ২০১৬ সাল অবধি মোট ৬৫ শতাংশ প্রসব বাসাবাড়িতে হয়েছে। বাকি ৩৫ শতাংশ, হয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা হাসপাতালে। ফলে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী বাচ্চাকে মায়ের দুধ পান করানোর গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক তথ্য পান না। ঠিকভাবে বাচ্চাকে কোলে রেখে দুধ পান করানোর নিয়মটাও তাই তাদের অজানা থেকে যায়। পরিবারের লোকজন যদি এ ব্যাপারে সচেতন না হন বা তাদের সচেতন করা না যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের দেশেও মায়ের দুধ পান করানোর হার আরো কমে যেতে পারে। ফলে জনসচেতনতা সৃষ্টির তাই বিকল্প নেই।
দ্বিতীয়ত. আমাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় এমনিতেই স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স এবং চিকিৎসকেরও অভাব রয়েছে। কিন্তু যাঁরা আছেন, তাঁরাও এ ব্যাপারে যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে কীভাবে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে বা মায়ের বুকের দুধ পান করলে মা ও শিশু দুজনের জন্যই তা কতটা উপকারী সেটাও হয়তো ঠিকঠাক জানেন না। বা জানলেও তা হয়তো ভাসাভাসাভাবে জানেন। ফলে প্রতিটি শিশুর মায়ের দুধ পান করার জন্মগত যে অধিকার, সেটা অর্জন করতে হলে এ ব্যাপারে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার তাই বিকল্প নেই।
তৃতীয়ত. প্রচার মাধ্যমে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুখাদ্যের নানা বিকল্প উৎস্য সম্পর্কে নিয়মিত প্রচার প্রপাগান্ডা চালায়। এসব দেখে জনগণ বিভ্রান্ত হন। কারণ তাদের সে বিজ্ঞাপনে থাকে এমন নামকরা সব মানুষের উপস্থিতি (বিজ্ঞাপনের ভাষায় যাকে বলে ‘মডেল’) যাদেরকে এমন পণ্যের প্রচারে দেখে সেসব পণ্যের নেতিবাচক গুণাবলি সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ করতে মন সায় দেয় না। তদুপরি পুষ্টিবিদ, চিকিৎসকসহ নানা জায়গায়, ঘাটে ঘাটে তারা অর্থ বিনিয়োগ করে যাতে এ সকল পণ্য সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রচারণা সে অর্থে চলতে না পারে। ফলে মায়ের দুধের সঙ্গে বা বিকল্প হিসেবে শিশুখাদ্যের নানা প্যাকেট বা কৌটাতে তাই বাজার সয়লাব। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষ্ঠানকে আরো সক্রিয় হতে হবে আইন প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে।
চতুর্থত. আমাদের দেশে এখন কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই শিশু জন্মের পরে তার বয়স ছয় মাস হওয়া অবধি মাকে ছুটি দেয় না। আবার ডে-কেয়ার সেন্টারও তারা স্থাপন করেনি। অনেক প্রতিষ্ঠান তো মাত্র দু-তিন মাস ছুটি দেয়। তাহলে কীভাবে আমরা একটা সুস্থ, সবল এবং নীরোগ বাচ্চার বেড়ে ওঠা দেখতে পাব? কীভাবে আমরা খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারব? এভাবে হলে তাহলে মেধাবী প্রজন্ম আমরা কীভাবে গড়ে তুলব?
পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে ১৫ থেকে ২০ ভাগ শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। অপুষ্টির কারণে প্রতিবছর অনেক শিশুর প্রাণহানিও ঘটে। অনেক শিশু খর্বাকৃত হয়ে বেড়ে ওঠে। অপুষ্টিজনিত এ সমস্যা দূর করতে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া বুকের দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে মায়ের সঙ্গে শিশুর এক চমৎকার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে; যা আর অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়। জন্মের পর থেকে ছয় মাস অবধি যদি শিশু মায়ের বুকের দুধ পান করার সুযোগ পায়, তাহলে তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পায়, মায়েরাও তেমনি স্তন ক্যানসারের হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে। এভাবে বিশ্বে আট লাখের বেশি শিশু এবং ২০ হাজারের মতো স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব (সূত্র : ল্যানসেট, ২৯ জানু, ২০১৬)।
আমরা অনেক সময় নানা রকম দিবস হয়তো পালন করে থাকি গতানুগতিকভাবে বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে। কিন্তু সপ্তাহব্যাপী মাতৃদুগ্ধ পালন দিবস বস্তুতপক্ষে গতানুগতিক পালনেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। কারণ একটা সুস্থ, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং মেধাসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস পরিপূর্ণভাবে শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর কোনো বিকল্প নেই। ছয় মাস পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশে যে কোনো স্বাস্থ্যসম্মত পরিপূরক খাবার দেওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে তাই সমন্বিত পদক্ষেপ জোরদারভাবে নেওয়া জরুরি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।