জলাবদ্ধতা
বর্ষায় নগরডুবির দায় নেবে কে?
আজি শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে
গোপন তব চরণ ফেলে
নিশার মতো নীরব ওহে
সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।
প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি,
বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,
নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি
নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছেন। হ্যাঁ, শ্রাবণে মুষলধারে বৃষ্টি হবে, রাস্তাঘাটে পানি জমবে, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সেই পানিতে খেলবে—এটাই স্বাভাবিক। এটাই বর্ষার সৌন্দর্য। কিন্তু এই সৌন্দর্য যদি হয়ে ওঠে ভোগান্তি, নগরের রাস্তাঘাট যায় পানিতে ডুবে, একবুক পানিতে ভিজে যদি রাস্তা পারাপার করতে হয়, তবে সেটা তো বর্ষার সৌন্দর্য হতে পারে না। কিন্তু মানুষের এই ভোগান্তির জন্য কাকে দায়ী করব আমরা।
গত মাস থেকে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ খুললেই প্রথমেই চোখে পড়ে কোনো না কোনো নগরডুবির শিরোনাম। বর্ষার এই অঝোরধারা ও নগরডুবির জন্য কাকে দোষারোপ করব আমরা। প্রকৃতি আজ নিজ নিয়মে চলছে না। প্রকৃতি আজ নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষ। তাই প্রকৃতিকেও আজ দায়ী করতে পারছি না আমরা। তাহলে কে নেবে এর দায়ভার? এর জন্য দায়ী আমরা নিজেই নাকি আমাদের জনপ্রতিনিধিরা।
বৃষ্টি হলেই ডুবে যাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ এলাকা। হাঁটু থেকে গলা পর্যন্ত পানিতে বন্দি হয়ে পড়ে জনজীবন। এই জলাবদ্ধতার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সিটি করপোরেশনের খাল দখল, অচল ড্রেনেজ। এর কারণ কী? আমাদের দেশের নদীগুলো দিন দিন মরে যাচ্ছে। ভরাট করা হচ্ছে নদীনালা ও খাল-বিল। কিন্তু এ নদ-নদীগুলোর খনন, সংস্কার, দখল ও দূষণমুক্ত করা হচ্ছে না।
এ ছাড়া যে উন্নয়নের কথা বলছি, সেটাও করা হচ্ছে না পরিকল্পনা অনুযায়ী। তাতে বর্ষা মৌসুমকে বিবেচনায় না নিয়ে কাজ করায় উন্নয়নকাজই যেন হয়ে উঠেছে জলাবদ্ধতার বড় কারণ। কেননা, বিভিন্ন প্রকল্পের জমিয়ে রাখা মাটিতে ভরাট হচ্ছে খাল-নালা। তাতে সামান্য বৃষ্টির পানিও সরছে অনেক দেরিতে। আবার কোথাও ফ্লাইওভার হচ্ছে, কোথাও নতুন পাইপলাইন নির্মাণে চলছে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি। কয়েক মাস ধরেই চট্টগ্রাম নগরীর রাস্তাঘাটে এমন কর্মকাণ্ডের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা গেছে।
এসব উন্নয়নকাজের কোনো কোনোটি এখন শঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে, বর্ষা মৌসুমের জন্য। কারণ, এসব কর্মকাণ্ডের কারণে কোথাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে খাল-নালা, রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ। উন্নয়নকাজের কারণে পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে চট্টগ্রামে প্রতিবছর ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এ ছাড়া শ্রাবণের এই সময়ে ঢাকার কয়েকটা রাস্তা যেন ডোবাতে পরিণত হয়েছে। ভোগান্তির অনন্ত নেই ঢাকাবাসীর। এখানে এক কথা না বললেই নয়। আমরা সকলেই জানি, ঢাকা শহর ভৌগোলিক কারণেই বৃষ্টিপাত অঞ্চল। মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের কারণে ঢাকায় তুলনামূলক বৃষ্টি বেশি হয়। তবে সেই বৃষ্টির পানি কোথাও যেতে পারে না।
কিন্তু এর কারণ কী? এর জন্য দায়ী কি শুধু নগর পিতারা, নাকি আমরা সাধারণ জনগণও এর জন্য দায়ী। আমরা তো ঢাকা শহরকে রীতিমতো একটা গামলা বানিয়ে ফেলেছি। ফলে বৃষ্টির পানি নগরীর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে জলাবদ্ধতা তৈরি করে। ঢাকার খালগুলো দখল এবং রাজধানীর চারপাশের নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি দ্রুত নামতে পারে না। ওয়াসার অধীনে থাকা ড্রেন পরিষ্কার হয় না। দুই যুগের বেশি সময় ধরে সম্পূর্ণভাবে ঢাকার ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। তবে এ পরিস্থিতির জন্য শুধু ঢাকা ওয়াসা একাই নয়, সিটি করপোরেশনও দায়ী। কারণ, আন্ডারগ্রাউন্ডের ড্রেনেজগুলো ঢাকা ওয়াসার আর সারফেস ও খোলা ড্রেনগুলো দুই সিটি করপোরেশনের। ওয়াসা তাদের অধীনে থাকা ড্রেনগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করতে পারছে না। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন যদি ৯০ শতাংশ বর্জ্যও ঠিকমতো সরাতে পারত, তাহলে বৃষ্টির পানির সঙ্গে বর্জ্য মিশে ড্রেন বন্ধ হতো না। ঢাকা শহরের মধ্যে বেশ কিছু বক্স-কালভার্ট আছে।
এসব কালভার্টে ওয়াসার ড্রেন থেকে সরাসরি ময়লা এসে পড়ছে। নিয়ম হলো, বক্স-কালভার্টে আসার আগে পানির মধ্যে কোনো ধরনের ময়লা থাকলে, মানে পলিথিন বা অন্যান্য আবর্জনা থাকলে তা সরিয়ে নিতে হবে। এরপর তা বক্স-কালভার্ট হয়ে খাল দিয়ে নদীতে গিয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে বক্স-কালভার্টে নানা ধরনের আবর্জনাসহ পানি আসছে। এ ময়লা জমে জমে কালভার্টগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আবার বিদ্যমান খালগুলোও সংস্কার করা হচ্ছে না। বহু জায়গায় প্রভাবশালীরা খাল দখল করে বসে আছে। ফলে যখন পানির চাপ বাড়ছে, তখন কিন্তু না বক্স-কালভার্ট, না খাল কোনোটিই পানি ধারণ করতে পারছে না। সে কারণেই জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
তাই বলতেই হবে, শ্রাবণের এই বর্ষার দিনে নগরীতে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তার দায় আমরা শুধু প্রকৃতিকে দিতে পারি না। এর মূল দায় নিতে হবে নগর পিতাদের।
পাশাপাশি খাল দখলবাজ ও অসচেতন নাগরিকরাও এর দায় এড়াতে পারেন না। আমাদের সবার সচেতনতা ও বর্ষা মৌসুমের বিপদ মাথায় রেখেই উন্নয়নকাজের পরিকল্পনা সাজানো উচিত। তবেই সাধারণ জনগণের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।