ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালা নিয়ে কয়েকটি কথা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে মোটাদাগে দুটি দায়িত্ব পালন করতে হয়, যার একটি ক্লাস নেওয়া (শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শেখানো); অপরটি গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং উভয়ের সংমিশ্রণে যুগোপযোগী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা।
সম্প্রতি ইউজিসি কর্তৃক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি বা পদোন্নয়নের জন্য অভিন্ন নীতিমালা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে; যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় এরই মধ্যে আলোচিত হয়েছে। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মতামত তুলে ধরার এই ছোট্ট প্রয়াস। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কেউ কষ্ট পেলে আমাকে ক্ষমা করবেন।
ক.
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে সাধারণত এসএসসি ও এইচএসসি মিলিয়ে ৭.৫ থেকে ওপরে জিপিএ চাওয়া হয় এবং যথারীতি ৭.৫ থেকে শুরু করে ওপরের ফলাফলধারী শিক্ষার্থীরা ভর্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে। যাদের আমরা ৭.৫ থেকে শুরু করে ওপরের যেকোনো ফলাফলের জন্য ভর্তির সুযোগ দিলাম, অভিন্ন নীতিমালা অনুযায়ী সেই তাদেরই বললাম তুমি কখনো শিক্ষক হতে পারবে না, কেননা তোমরা এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলে ৪.৫ করে মোট ৯.০ জিপিএ পাওনি!
আমরা কথায় কথায় বিদেশের কথা বলি, বিদেশি লেখাপড়ার উদাহরণ দিতে খুবই আগ্রহ অনুভব করি, কিন্তু আপনারা কেউ কি বলতে পারবেন, এমন কোনো দেশ আছে যেখানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এপর্যায়ের ফলাফলকে প্রাধান্য দেয়? আমি যতটুকু জানি তাতে শিক্ষক নিয়োগ এবং গবেষণার ক্ষেত্র ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে এপর্যায়ের ফলাফলকে প্রাধান্য দেওয়া তো দূরের কথা, কেউ চাকরি বা গবেষণার (এমফিল, পিএইচডি, প্রোস্টডক্টরাল) জন্য সে সমস্ত বায়োডাটা তৈরি করে থাকে তাতে কেউ ভুল করেও এপর্যায়ের ফলাফলকে উল্লেখ করে না।
আবার সনাতন পদ্ধতির ক্ষেত্রে এই নীতিমালায় কোনো কথা উল্লেখ নেই, অর্থাৎ সনাতন পদ্ধতিতে যদি কেউ আগে পাস করে থাকে তাহলে সে কি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হবে? যারা জিপিএ ৯.০ থেকে কম পেয়ে ভর্তি হয়েছে এবং অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় ৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে প্রথম শ্রেণি প্রথমসহ অনুষদে প্রথম হয়েছে, নীতিমালা অনুযায়ী তাদের বাদ দিয়ে যারা ৯.০ বা তার বেশি পেয়ে ভর্তি হয়েছে এবং অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় ৪-এর মধ্যে ৩.৫ পেয়েছে তাদেরকে শিক্ষক নিয়োগে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার সবিনয় একটি প্রশ্ন, নিয়োগকৃত শিক্ষকরা কি মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকতা করবেন? নাকি অনার্স বা মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষকতা করবেন? পাশাপাশি ভর্তির সময় তাদেরকে কখনো জানানো হয়েছে যে তুমি যত ভালো ফলাফলই করো না কেন, যত ভালো গবেষণা করো না কেন, যত ভালো পাবলিকেশনই থাকুক না কেন তুমি শিক্ষক হতে পারবে না। আমরা সবাই জানি তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি তাহলে এভাবে তাদেরকে নিয়োগবঞ্চিত করার নীতিমালা কি গ্রহণযোগ্য হবে? অবশ্যই হবে না বলে আমার বিশ্বাস।
খ.
নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফল এক থেকে পাঁচ-এর মধ্যে থাকতে হবে, যা একটি উত্তম প্রস্তাব বলে মনে হচ্ছে। ধরুন একটি ছাত্র একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে পঞ্চম হয়ে এরই মধ্যে পাস করেছে, যে বিশবিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগে ইউজিসি পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে। তারপরও সেই ছাত্রটি নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে পারবে কিন্তু যে ছাত্রটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট থেকে প্রথম শ্রেণিতে ষষ্ঠস্থান অধিকার করেছে তার নীতিমালা অনুযায়ী নিয়োগ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন তাহলে আপনারাই ভাবুন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট থেকে প্রথম শ্রেণিতে ষষ্ঠস্থান অধিকার করা ছাত্রটি কোনোভাবেই কি সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগে অভিযুক্ত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে পঞ্চম হয়ে পাস করা ছাত্রটির চেয়ে খারাপ? তাহলে নতুন নীতিমালা মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসার পথ কি বন্ধ করছে না?
গ.
নতুন নীতিমালায় কী করলে কখন কীভাবে পদোন্নতি হবে সেই অনুযায়ী শুধুমাত্র শিক্ষকতার বয়সের পাশাপাশি গবেষণার ফলাফল ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের জার্নালে প্রকাশের ওপর কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের জার্নালে প্রকাশনা থাকলেই চলবে কিন্তু শিক্ষকরা ছাত্রদের ভালো করে পড়াচ্ছে কি না? তাদের দক্ষ করে তুলতে পারছে কি না? সময়মতো ক্লাসে যাচ্ছে কি না? উল্লেখিত বিষয়গুলোতে ছাত্রদের মতামত নিয়ে ছাত্রদের মাধ্যমে শিক্ষকের পড়ানোর গুণগত মান নির্ণয় করা যা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য সে বিষয়ে কোথাও বলা হয়নি। শিক্ষককে শুধুমাত্র ভালো গবেষক হলেই চলবে তিনি ভালো করে ছাত্র পড়াতে পারেন কি না বা ভালো পড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করতে হবে কি না তা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, যা আমি আত্মঘাতী বলে মনে করি।
ঘ.
নীতিমালায় শুধু একটি ক্ষেত্রে পদোন্নতি (তৃতীয় থকে দ্বিতীয় গ্রেডে) পাওনা তারিখ হতে কার্যকর হবে বলা আছে কিন্তু অন্য গ্রেডগুলোর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের তারিখ থেকে কার্যকর হবে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বা বোধগম্য নয়।
ঙ.
নীতিমালা অনুযায়ী পদ শূন্য থাকলে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না, সে ক্ষেত্রে সরাসরি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অবস্থা বিরাজমান, তাতে এ নীতিমালা ‘মড়ার উপড় খাঁড়ার ঘা’ হবে বলে মনে করি; কেন না আমার নিজের ক্ষেত্রে সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপকের দুটি ক্ষেত্রেই সরাসরি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছে এবং তাতে প্রায় তিন বছরের বেশি সময় লেগেছে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে। তাতে মন খারাপ না করেই বলি এ ব্যবস্থা ভালো এবং সব ধরনের চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে মন্দ হয় না।
চ.
নীতিমালায় শিক্ষা ছুটির ক্ষেত্রে পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপের সময়কালকে সক্রিয় চাকরির অভিজ্ঞতা হিসেবে গণ্য করা হয়নি ফলে শিক্ষকরা ভবিষ্যতে গবেষণাকর্মে নিরুৎসাহিত বোধ করবেন। শিক্ষাজীবনে পিএইচডি ও পোস্টডক্টরাল মিলে মোট পাঁচ বছর সবেতনে ছুটির যে নীতিমালা আগে ছিল সেটাই গ্রহণযোগ্য, কেননা বিদেশে পোস্টডক্টরাল গবেষণাকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষক নিয়োগের সময় কমপক্ষে দুই বছরের পোস্টডক্টরাল অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। এ ধরনের নিয়ম চালু থাকলে শিক্ষকদের গবেষণার গুণগত মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হবে বলে আমার বিশ্বাস। শুধুমাত্র প্রতিক্ষেত্রে এক বছর করে সময় বাড়িয়ে পদোন্নতি দিয়ে কোন লাভ হবে না।
ছ.
নীতিমালায় একটি গ্রেডে পদোন্নতির ক্ষেত্রে হঠাৎ করে নতুন গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশনার কথা বলা হলো যা বোধগম্য কি? অন্য সবক্ষেত্রে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করার কথা থাকলেও এখানে নতুন গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশনার কথা বলে কী বোঝানো হলো?
জ.
ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রকাশনার ওপর খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই নীতিমালায় কিন্তু এই বিষয়টি খুব পরিষ্কার নয়, কেননা এটি পরিমাপের অনেকগুলো পদ্ধতি চলমান রয়েছে, যেমন, থমসন রাউটার-এর ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর যা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। এ ছাড়া রয়েছে, জার্নাল ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর (JIF), ARA Raking Journal (Q1, Q2, Q3,Q4), h5, h10 Indexing Journal, Google sited Indexing Journal-এর বাইরে রয়েছে অসংখ্য Online Journal যা টাকার বিনিময়ে প্রকাশ করা হয়; যাদের কিছু ভালো কিন্তু প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগেরই ভুয়া ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর। তাহলে নীতিমালায় এই বিষয়গুলো যথাযথভাবে তুলে না ধরে খুবই অপরিপক্বতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
ঝ.
উপরি-উক্ত বিষয়গুলোর বাইরেও যা বিশেষভাবে বিবেচ্য, তাহলো যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩ সালের অ্যাক্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয় তাদের সমস্ত কার্যাবলি সুচারুরূপে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের নিজস্ব বডি কাজ করে। যেমন- সিনেট, সিন্ডিকেট ইত্যাদি সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ভালো শিক্ষক বা গবেষক হলে তাঁকে কীভাবে সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাঁদের দায়বদ্ধতার জায়গাকে আরো দৃঢ় করা যায়, কীভাবে সামনের জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে করা যায়, এগুলোর ওপর জোর না দিয়ে মিলিটারি শাসকদের মতো ফরমান জারি করে গণতান্ত্রিকভাবে বেড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে অভিন্ন নীতিমালার দোহাই দিয়ে শুধু প্রমোশনকে দীর্ঘায়িত করে, শিক্ষকসমাজকে হেয় করে, শান্তিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অশান্ত করে, অচল করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে কে বা কারা সুচারুভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে তা বোধগম্য হচ্ছে না।
সবশেষে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার বিনীত আবেদন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব বডির মাধ্যমে শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি বা পদোন্নয়নের জন্য নীতিমালা তৈরির ভার দেওয়া এবং প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে একটা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যোগাযোগের মাধ্যমে এ বিষয়ের সমাধানে আপনি একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। এ ব্যাপারে সম্মানিত পাঠকদের সুচিন্তিত মতামত আশা করছি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইবিএস, রাজশাহী রিশ্ববিদ্যালয়।