অভিমত
কে ফিরিয়ে দেবে সিদ্দিকুরের চোখের আলো?
বলছি পুলিশের টিয়ার শেলে চোখ হারাতে যাওয়া সিদ্দিকুর রহমানের কথা । এত কাছ থেকেও যে পুলিশ টিয়ার শেল মেরেছে, গণমাধ্যমের ছবিতে স্পষ্ট, তা হারিয়ে যাবে সময়ের গর্ভে। এরপর খুব দ্রুতই ঘটবে অন্য সব ঘটনা।
হয়তো আমরা একদিন ভুলেই যাব সিদ্দিকুর বলে কেউ ছিল। তার দুটি চোখ ছিল। সে চোখে আলো ছিল। সে আলোয় সে বাংলাদেশ দেখত। দুনিয়া দেখত। মানুষ দেখত।
আমরা ভুলে যাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত তিতুমীর কলেজের একজন ছাত্র ছিল। সে হেঁটে হেঁটেই সেখান থেকে একদিন রাজধানীর শাহবাগে গিয়েছিল। অন্য অনেকের সঙ্গে স্লোগান তুলেছিল রুটিনসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার মতো মামুলি বিষয় নিয়ে। তারপর দেখতে পেলাম খুব কাছ থেকে একজন পুলিশ তার দিকে টিয়ার শেল ছুড়ে মারছে। কি ভয়ংকর!
অথচ শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কী সাবলীলভাবে বললেন, আন্দোলনকারীদের ছোড়া ইটে সিদ্দিকুরের চোখে আঘাত লেগেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে আমরা দেখলাম আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপের সময়ই তো পেল না। তার আগেই পুলিশ সদস্যরা তেড়ে গেলেন টিয়ার শেল নিয়ে। আর নিষ্ঠুরভাবে হাত মাপা দূরত্ব থেকে তা শুট করলেন।কিন্তু কেন ? মানবিক বোধ বুদ্ধি বিবেচনা কি হারিয়ে গিয়েছিল?
মাকে নিয়ে, নিজের পরিবারকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল সিদ্দিকুরের। তাই তো দ্রুতই শেষ করতে চাচ্ছিলেন পড়াশোনার পাঠ। ভালো ফল করতে চেয়েছিলেন। তাই খুব মামুলি একটা দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। সাহস করে দাঁড়িয়েছিলেন পুলিশের সামনে। কিন্তু তার খেসারত যে এত মারাত্মক হবে, ভাবতে পারেননি। চোখের সামনে ধেয়ে আসা সেই টিয়ার শেল দেখেও কি ভাবতে পেরেছিলেন , মুহূর্তেই সব অন্ধকার হয়ে যাবে! স্বপ্নের প্রদীপটা ধপ করে নিভে যাবে।
কত কষ্ট নিয়ে তাই মাকে বলতে হচ্ছে, ‘সিদ্দিককে তিন বছরের থুইয়া ওর বাপ মরছে। বড় পোলাডা রডের কাম কইরা ভাইডারে এতদূর পড়াইছে। এখন তো ওর চোখ গেছে। আমরা এখন কী করমু বাবা?’ কতটা অসহায় হলে এই মুহূর্তে তাঁকে বলতে হয়, ‘সরকার যেন আমার পোলাডারে একটা চাকরি দেয়’।
জানি, সিদ্দিকুরের জন্য আমাদের সবারই খুব কষ্ট হচ্ছে। কী অসহায় আমরা! যে পুলিশের হাতে রাষ্ট্র অস্ত্র তুলে দিয়েছে জনগণকে রক্ষা করার জন্য। অথচ কী আশ্চর্য তা কিনা বুমেরাং হয়ে আমাদেরই নিশানা করছে! আমাদের চোখ উপড়ে নিচ্ছে। আমাদের হাত-পা ভেঙে দিচ্ছে। আমাদের জীবন নিয়ে নিচ্ছে। অথচ রাস্তায় রাস্তায় অসংখ্য ব্যানারে শোভা পাচ্ছে ‘ পুলিশ জনগণের বন্ধু’। সেটাই তো হওয়ার কথা ছিল।
শুধু তাই নয়, পুলিশ তো আসলে জনগণের সেবক। কারণ, এই রাষ্ট্রের মালিক যে জনগণ! তাদের ভ্যাটের টাকাতেই তো রাষ্ট্র চলে। পুলিশেরও মাইনা হয়। যে পুলিশ সদস্যটির টিয়ার শেলের আঘাতে সিদ্দিকুর চোখ হারাতে বসেছেন, তাঁর বেতনেও কিন্তু সিদ্দিকুরের ভাগ আছে। ভাগ আছে রডের কাজ করা তাঁর বড় ভাইটির। কিন্তু কী পেল তার প্রতিদান?
এত বড় একটা ঘটনা ঘটল, অথচ অস্বীকার করেই পুলিশের দায়িত্ব খালাস। সরকারের লোকজনের খুব একটা নড়াচড়া নেই। তিনি যে আম-জনতা, তাই তার জন্য উদ্বেগ দেখানোরও কেউ নেই। তিনি তো আর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ছিলেন না যে তাঁর জন্য সরকারের বড় কেউ দ্রুত উদ্যোগ নেবেন। বুদ্ধিজীবীদের কলামও তাঁর জন্য খুব একটা শান দেবে না। হ্যাঁ, তাঁরা বলবেন। যখন সরকারের বড় কেউ এগিয়ে আসবেন, তখন তাঁরাও প্রশংসায় গদগদ হবেন। হয়ে উঠবেন প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল।
কিন্তু এটাই সত্য যে, আমাদের জোর গলায় বলতে হবে এবং সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে সিদ্দিকুরের চোখের আলো ফেরানোর জন্য। তিতুমীর কলেছের অধ্যক্ষের কোনো প্রতিবাদ শুনলাম না। মন্ত্রী বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাদের কেউ বলছেন, দায়ী পুলিশকে খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে!
তবে আমরা আশা করতে চাই, এসব উদ্যোগ আমরা শিগগিরই দেখতে পাবে। আমরা দেখতে চাই না, পুলিশ ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করুক। ক্ষমতার বলে সেটা হয়তো পেরে উঠতে পারেন তাঁরা। কিন্তু এটা মনে রাখা উচিত, জনগণেরও আদালত আছে। মানুষেরও একটা আদালত আছে। সেখানেও সব কিছুর বিচার হয়। তার ফল হয়তো দ্রুত পাওয়া যায় না। কিন্তু একটা সময় কিন্তু ঠিকই ফলে। আর সেটা না হলে যে সিদ্দিকুরের চোখের মতো আমরাও অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাবে। এই প্রিয় বাংলাদেশকে দেখার মতো কোনো চোখ থাকবে না!
লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।