রাজধানী কেন অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যায়? এর উত্তর আমরা কার কাছ থেকে পাব? রাজধানীর দেখভালের দায়িত্ব জেলা প্রশাসন, ঢাকা ওয়াসা আর সিটি করপোরেশনের, মোটাদাগে এটাই আমরা জানি। এর সঙ্গে আরো অনেক সংস্থার যোগ রয়েছে। যারা কাজ করে ওই তিনটি সংস্থার মাধ্যমেই।

কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয়, ওই তিনটি সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।

বৃষ্টি হবেই, এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। বৃষ্টিকে থামিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। বৃষ্টির পানি নগরকে ধুয়েমুছে, নগরের গাছপালার ধুলাবালি সাফ করে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাবে উন্মুক্ত স্থানে, অর্থাৎ খাল, জলাশয়, বিল-ঝিল কিংবা লেকে। এটাই হওয়ার কথা। কোথাও পানি জমে থাকবে না।

কোথায় সেই লেক? কোথায় সেই জলাশয়? কোথায় সেই ঝিলখ্যাত মতিঝিলের ঝিল? ঢাকা শহরের বেশির ভাগ জলাশয় আর ছোট খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে দালানকোঠা। গড়ে উঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কারা তুলেছে সেই দালানকোঠা আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান? সাধারণ মানুষ না তারা। তারা কখনো রিকশাযাত্রী হয়ে জলজটে পড়ে না। তাদের মা-বোনেরা স্কুলপড়ুয়া সন্তান নিয়ে বৃষ্টির দিনে কোমর ছুঁইছুঁই পানির মধ্যে উল্টে পড়ে আহত হন না। তাদের যানজটে পড়ার কারণে অফিস-আদালতে দেরিতে প্রবেশ করায় বসের বকুনি খেতে হয় না।

তাদের টিকিটি ধরার ক্ষমতা নেই জেলা প্রশাসনের। জলাশয় আর খাল রক্ষার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। প্রত্যেক সরকারের আমলেই একটু একটু করে ঢাকায় বৃষ্টির পানি যেখানে নেমে যাওয়ার কথা সেই জলাশয় ভরাট করে, খাল ভরাট করে আবাসন গড়ে তুলেছে প্রভাবশালীরা। প্রশাসন তাদের বাধা দিতে পারেনি। কারণ, তারা কোনো না কোনোভাবে সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কখনো কখনো পত্রপত্রিকায় একটু লেখালেখি করলে প্রশাসন পুলিশ নিয়ে হম্বিতম্বি দেখায়, সে খবর ছাপা হয় পত্রিকায়। কিছুদিন চুপ থাকার পরে আবার শুরু হয় জলাশয় ভরাটের মহা উৎসব।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক সম্প্রতি বলেছেন, ‘ঢাকার খালগুলোর মধ্যে এখন দুটাও বোধ হয় নেই। খাল ভরাট করে সেখানে চার-পাঁচতলা ভবন করা হয়েছে। পানি যাবে কোথায়?’ তবে মেয়র দাবি করেছেন, ‘এর জন্য সিটি করপোরেশন কোনোভাবেই দায়ী নয়। খালের মালিক জেলা প্রশাসন, আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ওয়াসার। তারা ২৫ বছরে এই খাল কী রক্ষণাবেক্ষণ করেছে, তার হিসাব দিক।’

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা সবচেয়ে খারাপ। অনেক ড্রেনের অস্তিত্বই নেই। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য যে ড্রেন তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না হওয়ায় মাটি জমে ভরাট হয়ে গেছে। সুতরাং পানি সড়কেই জমে থাকে। আবার যত্রতত্র উন্নয়নকাজ চলছে। রাস্তার মাটি কেটে পাশেই স্তূপ করে রাখা হয়। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে ড্রেনের ভেতর চলে আসে। পানি যাওয়ার পথ থাকে না। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

জলাবদ্ধতা থেকে রাজধানীবাসী পরিত্রাণ পাবে, সেটাই বড় কথা। কার কী দায়িত্ব, সেটা দেখার বা বোঝার কথা না সাধারণ মানুষের। তারা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারবে, সেটাই বড় কথা। আর তারা যাতে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হন, সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের।

তাই কে বা কারা সরকারের কাছের মানুষ, সে বিবেচনা থেকে দূরে থেকে, ঢাকার সব অবৈধ দখলদারের স্থাপনা ভেঙে ফেলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে না করলে ঘরের ভেতর বৃষ্টির পানি চলে আসবে একদিন। যদিও এখনই অনেক এলাকার বাড়ির নিচতলা সামান্য বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

বর্ষাকালে যাতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সে জন্য এখনই জেলা প্রশাসন, ঢাকা ওয়াসা আর সিটি করপোরেশনকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি রাজধানীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেসব ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান করে থাকে, তাদের সচেতন হতে হবে, যাতে তাদের খামখেয়ালির জন্য নগরবাসীকে ভোগান্তিতে পড়তে না হয়।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিম এ খান বলেছেন, ‘ঢাকার ৬২টি খালের মধ্যে ২৬টি আছে। এর মধ্যে ১৩টির উন্নয়ন হয়েছে। আর বাকি ১৩টির উন্নয়ন চলছে।’

তা হলে প্রশ্ন, ৩৬টি খাল গেল কোথায়? সেগুলো কি প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে?

লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।