বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তিপরীক্ষা কেন নয়?
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই শিক্ষার্থীদের মাথায় নেমে আসে ভয়ঙ্কর এক চাপ। মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তাঁরা। তা ছাড়া বাংলাদেশে এখন ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাইলেই একজন শিক্ষার্থী তাঁর পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন না। আর যদি হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। এ জন্য নানামুখী দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা, ভোগান্তি ও মানসিক চাপের শিকার হতে হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।
কারণ হিসেবে প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীর তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কম আসনসংখ্যা, আর বাংলাদেশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পদ্ধতিকেই দায়ী করতে হবে। ভর্তি পরীক্ষা নামে এক জটিল ও ভোগান্তিময় যুদ্ধ অতিক্রম করতে হয় ভর্তিচ্ছুদের।
চলতি ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ১৪ অক্টোবর, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২১ অক্টোবর, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১৭ নভেম্বর, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০ অক্টোবর, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ নভেম্বর। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৪ নভেম্বর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৮ নভেম্বর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১৭ নভেম্বর এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় ২ ডিসেম্বর।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৫ থেকে ৮ নভেম্বর, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১৮ নভেম্বর, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৯ ও ১০ নভেম্বর, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২৭ অক্টোবর, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০ ও ২১ ডিসেম্বর, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৩ ও ৪ নভেম্বর, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মার্চ চতুর্থ সপ্তাহ ২০১৮।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৮ থেকে ১৮ অক্টোবর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ২২ থেকে ২৬ অক্টোবর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ২২ থেকে ৩০ অক্টোবর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ২৫ থেকে ২৯ নভেম্বর, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস ২৪ ও ২৫ নভেম্বর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ১৭ ও ১৮ নভেম্বর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯ থেকে ২৩ নভেম্বর, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ২৪ ও ২৫ নভেম্বর, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ থেকে ৩০ নভেম্বর, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ১১ নভেম্বর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ৮ ডিসেম্বর এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ৫ নভেম্বর। এ ছাড়া ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা একই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে তারা এখনো তারিখ ঘোষণা করেনি। তবে ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা মূলত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত হয়।
ভর্তি পরীক্ষার এই তারিখগুলো দেখে এটা স্পষ্ট যে, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তাদের মানে- ভর্তিচ্ছুদের শুরু হবে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়াদৌড়ি। যোগ্যতা ও স্বপ্ন থাকলেও ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না অনেক শিক্ষার্থী।
আবার দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি, ছয়টি, আটটি, এমনকি এর চেয়েও বেশি অনুষদ রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক ইউনিট বা বিভাগে আবেদন করতে পারেন। ফলে পছন্দের শীর্ষে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পছন্দের শেষ দিকে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিটে ভর্তি হতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই একাধিক আবেদন করেন। প্রতিটি আবেদনের সঙ্গে ৩৫০, ৪০০, এমনকি ৮০০ বা এক হাজার টাকা করে ফি জমা দিতে হয়। অর্থাৎ শুধু ফরম জমা দেওয়া বাবদই একজন শিক্ষার্থীকে বিপুল টাকা দিতে হয়। অন্যদিকে এ অর্থ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় অভিভাবকদের।
তা ছাড়া মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের প্রথম পছন্দ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ, পড়ালেখার খরচ কম। কিন্তু এই ‘কম খরচের বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ভর্তি হওয়ার জন্য তাঁদের অভিভাবকদের ব্যয় করতে হয় বিপুল অর্থ। এইচএসসি পরীক্ষার পর কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া, গ্রামের হলে ঢাকায় থেকে তিন-চার মাস থাকা-খাওয়া এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন ও পরীক্ষা বাবদ একেকজনের ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়ে যায়।
শিক্ষার্থীদের দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়াদৌড়ি ও আর্থিক খরচের কথা চিন্তা করে গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার দাবি উঠেছে বেশ আগেই। স্বয়ং ইউজিসির একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদনেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিকে ত্রুটিপূর্ণ, ব্যয়বহুল ও কোচিং-নির্ভর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণায় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি গুচ্ছ করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
তবে কেন এমনটি করা হচ্ছে? কেনই বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে না? যেখানে দেশের শিক্ষাবিদরা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার কথা বলছেন, সেখানে মূলত আর্থিক লাভের জন্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই প্রক্রিয়ায় পা বাড়াচ্ছে না। অথচ তারা দাবি করছে- গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা নিলে তারা তাদের যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থী পাবে না।
তাদের এমন যুক্তিতে প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক যে- দেশের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো যদি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে ফলাফলের ভিত্তিতে কে কোন মেডিকেলে পড়বেন, তা ঠিক করে দিতে পারে, তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন তা পারে না? সমস্যা কোথায়?
সরকার যদি একযোগে মাসব্যাপী আট-নয় লাখ শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন মাত্র দুই লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর ভর্তি পরীক্ষা একযোগে নিতে পারবে না?
শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ ও আর্থিক বিষয়টি বিবেচনা করে হলেও গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা অতিব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ভর্তি ফরম পূরণ করার সময় ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও পছন্দের বিষয়ের তালিকা দিতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকলে উচ্চশিক্ষা একটি স্ট্যান্ডার্ডে মধ্যে চলে আসত। কোয়ালিটি নিশ্চিত করা যেত।
এ পদ্ধতি চালু হলে শিক্ষার্থীদের একদিকে যেমন খরচ কমতো, ভোগান্তি কমত। অনিশ্চয়তা দূর হতো, তাঁদের চাপ কমত। এতে ভর্তি পরীক্ষার সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর চাপ কমে আসত। কারণ এর ফলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার মাধ্যমেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারত শিক্ষার্থীরা।
লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।