অভিমত
পানিবন্দি মানুষগুলো যাবে কোথায়?
প্রবল বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের নদ-নদীতে পানি বেড়ে গিয়ে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যা অব্যাহত রয়েছে। আগামি কয়েক দিনও এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় বন্যাকবলিত এলাকার পানিবন্দি মানুষজন নিজেদের এবং তাদের গবাদিগুলো নিয়ে পড়েছে ভয়াবহ সংকটে।
দেশের উত্তর, মধ্য ও পূর্বাঞ্চল বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। কয়েক লাখ লোক পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। অনেকেই আবার আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বন্যাদুর্গত মানুষদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে স্কুলের ষাণ্মাসিক পরীক্ষা। যদিও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে কর্তৃপক্ষ কাউকে জোর করে বের করে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করছেন। বলছেন, আশ্রিতদের বাড়ি থেকে পানি নেমে যাওয়ার কারণে তারা নিজেরাই চলে গেছে।
সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, জামালপুর, বগুড়াসহ অনেক এলাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কিছু জায়গার উন্নতি হলেও মৌসুমি বর্ষণে ফের আগের অবস্থায় চলে যাচ্ছে, অথবা আরো অবনতি হচ্ছে। তার ওপর আছে সিলেট বিভাগ সহ হাওর অঞ্চলের চৈত্রের শুরুর বন্যা যেখানে ফসল সব ভেসে গেছে বানের জলে। আগে থেকে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়া মানুষগুলো পড়েছে মানবিক সংকটে।
সিলেট, সুনামগঞ্জের অনেক এলাকা দীর্ঘদিন থেকে পানির নিচে থাকার কারণে সেখানে মানুষের কাজ নেই, রোজগার না থাকার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রথম দিকে কিছু জায়গায় ত্রাণ পৌঁছালেও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ত্রাণ ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বেশির ভাগ জায়গায় ওএমএসের চাল বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে বন্যাকবলিত ও নিম্ন আয়ের মানুষ কম দামে চাল কেনার সুযোগ পাচ্ছে না। মানুষের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ না পৌঁছালেও সরকার ও প্রশাসন জোর গলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে বলে দাবি করছে। আমরা সরকারি গুদামের প্রকৃত মজুতের তথ্য নিশ্চিত করে হয়তো জানি না, তবে সময়মতো যে মানুষজন ত্রাণ পাচ্ছে না, এবং ওএমএস অনেক জায়গায় বন্ধ হয়ে গেছে সেটা পরিষ্কার। যদিও গত শনিবার (৮ জুলাই) সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ত্রাণ বিতরণকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে, কিন্তু অনেক সময় সময়মতো দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মন্ত্রীর বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশকে সত্য হিসেবে ধরে নিলে এখান থেকেই পরিষ্কার মানুষের দুর্ভোগের চিত্র।
ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় সরকার ও প্রশাসন এবার সফল হতে পারেনি। বন্যার পূর্বাভাস থাকলেও সতর্কতা ছিল না সামান্যই। গত চৈত্রে আগাম বন্যায় সুনামগঞ্জের ছোট-বড় মিলিয়ে ২৪১টি হাওর ভেসে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্মরণকালের ভয়াবহ সে দুর্যোগের সময়েও হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বিদেশ সফরে ব্যস্ত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গেলেও জনদাবি সত্ত্বেও হাওর এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হয়নি। উপরন্তু ত্রাণসচিব সেখানে এক আলোচনায় কোনো এলাকায় অর্ধেকের বেশি লোক মারা গেলে সেটাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হয় বলে বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন; যদিও পরে তিনি তার সে বক্তব্য অস্বীকার করেছিলেন।
হাওরের বন্যার পেছনে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি-অনিয়মের যোগসূত্র রয়েছে। সে হিসেবে দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এটাকে ইতিবাচক ধরে নেওয়া যায়, কিন্তু দুর্গত এলাকার জন্য প্রাথমিক কাজ ত্রাণসহায়তা সেটা পর্যাপ্ত নয়। ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় সরকার-প্রশাসন এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে বলা যাবে না। ওএমএস-এর চাল বিক্রি বন্ধ ও বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বন্যাকবলিত এলাকায়। এমন অবস্থায় পানিবন্দি মানুষজন দিশেহারা, কোথায় যাবে তারা?
পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে যে, প্রতিবছর জুলাই-আগস্ট মাসে ভারি বর্ষণের সঙ্গে পাহাড়ি ঢলে দেশের ২০-২৫ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। এবার আগেভাগে বৃষ্টি শুরু হওয়ার কারণে খারাপ হয়ে গেছে বন্যা পরিস্থিতি। সিলেট অঞ্চলে টানা বৃষ্টিপাত এবং উজানের ঢলের কারণে বন্যায় দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে, তার ওপর আছে চৈত্র শুরুর আগাম বন্যার ধকল। ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাজে সময় অতিবাহিত করছে।
২০০৭ সালে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ২০১৩ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে মাত্র ১০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। ২০১৫ সালেও প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা বন্যাকবলিত হয়। গত কয়েক দশকে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে, তখন ৬৮ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল ৬১ শতাংশ এলাকা। এবার কত শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে গেছে এরই মধ্যে, এখনই এর কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি, এখনই পাওয়া হয়তো সম্ভব নয়; কারণ এখনো অনেক এলাকা নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। তবে গত কয়েক বছরের কাছাকাছি অবস্থায় এরই মধ্যে চলে গেছে এবং আরো অবনতির আশঙ্কায়।
বন্যা এসেছে, মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ বাড়িয়ে একসময় হয়তো চলেও যাবে; কিন্তু মানুষের দুঃখ-দুর্দশার যে চিত্র তা এবার কেবল দুর্গত মানুষজনই টের পেয়েছে। মিডিয়ায় বন্যার চিত্র কিছুটা আসলেও পুরোপুরি আসেনি। আর যতখানি এসেছে তা নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো আলোচনাও হয়নি। ফলে সরকার-প্রশাসনের জবাবদিহির জায়গাটা শক্ত হয়নি। অন্য অনেক ইস্যুর ভিড়ে মানুষের কষ্টগুলো চাপা পড়ে গেছে। দিনশেষে বন্যাসৃষ্ট মানবিক সংকট ব্যক্তিক যাতনায় রূপান্তর ঘটেছে। অথচ এর উল্টো হওয়ার কথা ছিল; ব্যক্তিক যাতনা সামষ্টিক রূপ পরিগ্রহ করলে সরকার-প্রশাসন তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতো।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে বন্যা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়ে সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া দরকার। কেবল প্রাকৃতিক কারণেই বন্যা হয় এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অবাধে খাল, জলাশয় ও নদী ভরাট, পাহাড় কাটা, দখলসহ সর্বগ্রাসী মানসিকতার অপরাধীদের দমনের পাশাপাশি বন্যা-পূর্ব সময়ে দেশের নিম্নাঞ্চলগুলোতে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে হবে। বন্যাকালীন বন্যাকবলিত মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ এবং বন্যা-উত্তর ওই এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত মেডিকেল টিম পরিচালনার মাধ্যমে রোগবালাই থেকে মানুষদের রক্ষা করতে হবে।
ফি-বছর বন্যা আসবেই ধরে নিয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রস্তুতি থাকলে বন্যা মোকাবিলা ও মানুষদের রক্ষা করা সরকারের জন্য কঠিন কাজ না। এ জন্য দরকার যথাযথ উদ্যোগ।
আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে আমরা প্রস্তুত নই। কবে নেব প্রস্তুতি, কিংবা আদৌ নেব কি- এটাই সম্ভবত বড় প্রশ্ন!
লেখক : কবি ও সংবাদকর্মী, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম