অভিমত
সাংসদদের গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া কাঙ্ক্ষিত ছিল
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া সংক্রান্ত সংবিধানের যে সংশোধনী পাস করেছিল সংসদ তা বাতিলে করে দেওয়া হাই কোর্টের রায়কে বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ, এটা পুরোনো সংবাদ। তবে এ পুরনো সংবাদ ফের আলোচনায় আসছে কারণ এনিয়ে সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্যরা। এ ধরনের আলোচনাতেও অসুবিধার কিছু ছিল না যদি তা গঠনমূলক, শোভনীয় পর্যায়ে থাকত।
সাধারণত সাধারণীকরণ প্রতিক্রিয়া আমরা দেখে থাকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগের নামে অসামাজিক প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এটা হয়ত স্বাভাবিক, কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষত ফেসবুকে ব্যক্তি নিজেই লেখক, সম্পাদক এবং প্রকাশক। ফলে ভাষা ব্যবহারের পরিশীলিত ও সুন্দর রূপের আকাঙ্ক্ষা সব ক্ষেত্রে পূরণ হয় না। বহতা নদীর মত বহমান সে স্রোতে ভেসে আসতে পারে কাঙ্ক্ষিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, বিবেচনাপ্রসূত ও অবিবেচক চিন্তার স্রোত। এটাকে স্বাভাবিক বিষয় ধরে নিয়েই আমাদের দিনযাপন।
তবে অদ্যকার আলোচনা জাতীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের কয়েকজনের যারা জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, সেটা অনেকক্ষেত্রে দুঃখজনক। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে সেখানে বক্তব্য গঠনমূলক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অনেকটা ফ্রি-স্টাইল বক্তৃতা হয়েছে।
যারা বক্তব্য দিচ্ছিলেন তারা আমাদের জনপ্রতিনিধি; যৌক্তিক, সচেতন-শিক্ষিত ও পরিশীলিত প্রকাশই কাঙ্ক্ষিত ছিল। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদেরকে অস্বীকার করার উপায় নাই। অস্বীকার করলে সেটা সংবিধানকেই অস্বীকার করা হবে। তাঁরা মাননীয় সংসদ সদস্য, কেউ কেউ আবার মন্ত্রিসভার সদস্যও।
বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী জেনেছে এবং দেখেছে যে তাঁরা প্রধান বিচারপতি, বিচার বিভাগ ও প্রধান বিচারপতি কর্তৃক নিযুক্ত আইনি পরামর্শক অ্যামিকাস কিউরিদের প্রতি আপত্তিকর, অপমানজনক মন্তব্য করেছেন। এমন অবস্থায় প্রশ্ন ওঠতে বাধ্য যে তাঁরা এমন করতে পারেন কি না? কারণ বিচার বিভাগের রায়কে এভাবে তাঁরা সমালোচনা, সহজ করে বললে বলা যায় আক্রমণ করতে পারেন কি না। তা ছাড়া বিচারপতি অপসারণের যে ক্ষমতা জাতীয় সংসদ দীর্ঘ বিচারিক ও আইনি প্রক্রিয়ায় হারিয়েছে সে সংসদ ক্ষমতা হারিয়ে যখন আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে তখন নিশ্চয়ই একে গুরুত্ব দিয়েই দেখতে হয়!
এটা ভেবে নেওয়ার উপায় নাই যে জাতীয় সংসদের ৩৫০ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৯/১০ বক্তব্য দিয়েছেন ফলে এটা জাতীয় সংসদের বক্তব্য নয়। এর কারণ আড়াই ঘণ্টার দীর্ঘ আলোচনায় সংসদের সভাপতিত্ব করছিলেন স্পিকার স্বয়ং, সংসদে উপস্থিত ছিলেন সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবার অবকাশ নাই। তা ছাড়া আক্রমণাত্মক ভাষার বক্তব্য প্রদানকালে স্পিকার কোনো রুলিং দেননি, আক্রমণাত্মক, অপমানজনক কিংবা আপত্তিকর কোনো বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা হবে বলেও কিছু বলেন নাই, ফলে ধারণা করা যায় এসব বক্তব্য জাতীয় সংসদের রেকর্ডে থেকে যাবে। অথচ যাদের নিয়ে এমন বক্তব্য দেওয়া হলো সেই সংসদে তাঁদের বক্তব্য, জবাবদিহি কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই।
এবার দেখি কারা ছিলেন সে আলোচনায়। শুরুটা করেছিলেন জাসদ একাংশের নেতা মঈনুদ্দিন খান বাদল। অংশ নিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জিয়াউদ্দিন বাবলু, আলী আশরাফ, রুস্তুম আলী ফরাজি ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম। এ আলোচকদের মধ্যে সংসদের প্রথম সারির নেতা, বিরোধী দলের সাংসদ, আওয়ামী লীগ জোটের নেতারা ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রয়েছেন। অর্থাৎ সব দলের সদস্যদের নিয়ে এ আলোচনা হয়েছে।
আলোচনায় মঈনুদ্দিন খান বাদল প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি আপনার বিচার করতে পারেন না। আপনি কি স্বয়ম্ভু ভগবান যে আপনি নিজেই নিজের বিচার করবেন। আপনি কি আল্লাহ হয়ে গেছেন, যে বলিলাম আর হয়ে গেল?’ শেখ ফজলুল করিম সেলিমও একইভাবে প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণ করেছেন। প্রধান বিচারপতি কর্তৃক বিস্তর আইনি ব্যাখ্যার জন্য নিরপেক্ষ মতামত শুনতে নিযুক্ত অ্যামিকাস কিউরিদের সম্পর্কে কটূক্তিও করেছেন। ওই বেঞ্চের অ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেনকে উদ্দেশ করে শেখ সেলিম বলেছেন, ‘কোথাকার ডক্টর আমরা জানি না। উনি কি মুরগির ডাক্তার নাকি ছাগলের ডাক্তার না ভেড়ার ডাক্তার, না এমনি ডাক্তার। এই ডাক্তার সে প্রেসক্রিপশন একটা দিয়ে দিছে যে সংসদ পারবে না, সুপ্রিম জুডিশিয়াল করবে। আপনি কানে হাত দিয়ে উঠেন বসেন। আপনি ৭২-এর সংবিধান প্রণেতা এটা বলতে পারেন না।’
শেখ সেলিম দাবি করেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট নিজেরাই সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধ রায় দিয়েছেন’। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু কতটুকু স্বাধীন। সংসদের চেয়েও স্বাধীন? তা হতে পারে না।’ মানে তাঁর ভাষায় এ রায় ‘অবৈধ’। প্রশ্ন ওঠে একজন সংসদ সদস্য সুপ্রিম কোর্টের রায়কে এভাবে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিতে পারেন কি না? শেখ সেলিম বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি আরো প্রশ্ন রেখেছেন যে, বিচার বিভাগ কি সংসদের চাইতেও স্বাধীন?
এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, রাষ্ট্রের আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি স্বীকৃত। আলোচিত মাসদার হোসেনের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এ রায়ের মাধ্যমেই প্রকাশিত এবং দৃশ্যমান। সেক্ষেত্রে কেন তিনি বিষয়টিকে ঘোলাটে করতে চাইছেন? তা ছাড়া আপত্তিকর ভাষায় ও ইঙ্গিতে জোরগলায় কোনো সত্যের বিপক্ষে দাঁড়ালেই সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।
বাকি সংসদ সদস্যদের বক্তব্য উল্লেখের আর আর প্রয়োজন নাই। তাদের সবাই যে কেবল প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণ করেছেন তা না, বেশির ভাগই তাদের বক্তব্যে রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। এর পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজেছেন। অথচ তারাও জানেন সব ধরনের আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই এ রায় এসেছে। এখানে সরকারপক্ষের বক্তব্য শোনা হয়েছে, সরকারপক্ষকে সময়ও দেওয়া হয়েছে তাদের প্রস্তুতি ও বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য। রাষ্ট্র যদি তাদের স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারে সেক্ষেত্রে ব্যর্থতা তাদের।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল হয়ে যায় না। যদিও রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদ জানিয়েছেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল থাকার কথা। ফলে এটা ফের ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। যদিও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর জানা যাবে এ নিয়ে রায়ে কোনো নির্দেশনা আছে কি না। রায়ে নির্দেশনা থাকলে সে অনুযায়ী হবে, না থাকলে ফের সংসদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। অবস্থা যাই হোক প্রশ্ন ওঠতে বাধ্য যে, বিক্ষুব্ধ এ সংসদ কি এ ক্ষেত্রে সঠিক ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?
রায়ে যদি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের নির্দেশনা থেকে থাকে তাহলে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ এটা বাস্তবায়ন করবে, আইন বিভাগের ওপর আর দায়িত্ব বর্তাবে না, বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেও কোনো কাজ হবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। তবে তার আগে বাজে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়ে গেছে সংসদ কর্তৃক।
বর্তমানে মিডিয়ার মাধ্যমে সারাদেশের মানুষ সংসদের বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখেছে। বিচার বিভাগ, প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে সাংসদদের আক্রমণ দেখেছে। এতে বিচার বিভাগ ও প্রধান বিচারপতিদের প্রতি মানুষের কতখানি আস্থা-ক্ষয় হয়েছে জানি না, তবে সাংসদগণ নিশ্চিতভাবেই সম্মান হারিয়েছেন অনিয়ন্ত্রিত বক্তব্যের কারণে।
ইত্যবসরে বিএনপি তাদের প্রতিক্রিয়ায় আদালতের এ রায়কে গ্রহণ করে বলেছে, এতে করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রকাশ হয়েছে, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। অথচ এ বিএনপিই আবার যেকোনো রায় তাদের বিপক্ষে গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নাই বলে অভিযোগ করে থাকে। ফলে বলাই যায়, রাজনীতিবিদদের ধর্মই হচ্ছে যখন কিছু নিজেদের পক্ষে যায় তারা প্রশংসায় উচ্চকণ্ঠ হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ কথায় কথায় দাবি করে তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে, কিন্তু যখনই তাদের মনমত রায় আসেনি তখনই তারা স্বাধীনতার ওপর খড়গহস্ত হতে উঠেপড়ে লেগেছে। এটা তাদের স্ববিরোধিতা, নিঃসন্দেহে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতি সাংসদদের আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ায় আমরা স্বাভাবিকভাবে আশাহত। আইনপ্রণেতাদের কাছ থেকে গঠনমূলক ও দায়িত্বশীল আচরণ নাগরিকেরা প্রত্যাশা করে।
লেখক : সংবাদকর্মী।