নাগরিক ঈদ
নিঃসঙ্গ ঢাকায় ঈদের দিনগুলো
রমজান মাস আসার বেশ কদিন আগে থেকেই আমার মধ্যে ভালো লাগার এক মিষ্টি অনুভূতি কাজ করে। এ রকম পবিত্র মাস বছরে একবারই আমাদের জীবনে আসে। আর রোজার শেষে আসে ‘খুশির ঈদ’।
ঈদের দিন আগের রাতে রান্না করা সেমাই-জর্দা খেয়ে স্বামী-ছেলে মসজিদে যায়। আর আমরা (মা-খালা-বোনদের) রান্নাঘরে যাই। সেদিন যেন নিজের হাতের রান্নাতেই শান্তি। মাংস রাধি, পোলাও রাধি, চাখি, কখনো বা রান্না হওয়ার ফাঁকে একটু একা বসি বা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। দেখি, নিচে মসজিদ থেকে যাঁরা ফিরছেন, তাঁরা কেউ কাউকে চিনুক/না চিনুক কোলাকুলি করছেন। ভাবি, সব সময় কেন মানুষগুলো এভাবে মিলেমিশে থাকতে পারে না? দেখি, কিশোরী মেয়েরা নতুন ড্রেসে সেজে পরীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফিরে যাই নিজের কিশোরী বেলায়।
বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কারণে থাকতাম ফুলার রোডে, কোয়ার্টারে। নব্বইয়ের দশকে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া চারপাশটা খুব বেশি ঘোরাফেরার জন্য খারাপ ছিল না। তাই অভিভাবকরা এখনকার মতো সন্তানদের একলা ছাড়তে খুব বেশি ভয় পেতেন না। তাই আমরা দু-তিনজন বন্ধু এদিক-সেদিক ঘুরতাম। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। তাই নিজ দায়িত্ববোধ থেকেই সারা দিন ঘোরার পর দুপুর বেলায় বাসায় ফিরতাম। বাসায় ফিরেই দেখতাম, টেবিলে সাজানো মায়ের নানা রান্না। টেবিলে খেতে বসার আগেই টুপ করে মা-বাবাকে সালাম দিতাম, সালামি যা পাই তাতেই খুশি।
বাবা নিজে সব সময় পড়তেন। আমাদেরও বলতেন, ঈদের দিন শুধু ঘোরাঘুরি নয়, ‘আউটবুক’ কিছু পড়ো। আমার তাঁর কথা শুনে সে সময় থেকে আজও ঈদের ছুটিতে (কারণ এ সময় আমরা—চাকরিজীবীরা লম্বা ছুটি পাই) কোনো একটা ভালো বই, যা অনেক দিন ধরে পড়তে চাইছি, কিন্তু সময়ের অভাবে পড়তে পারছিলাম না, সে রকম একটি বই পড়ার অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন পত্রিকার প্রকাশিত ঈদসংখ্যাগুলো পড়তেও বরাবরই আমার বেশ লাগে। সে সময় ঈদের রাতে নাটক/টেলিফিল্ম বা ছায়াছন্দ দেখার জন্য কতই না পাগল থাকতাম (আজ এত চ্যানেল, এত অনুষ্ঠান, কোনোটাই বিজ্ঞাপনের ঠেলায় পুরোটা দেখে উঠতে পারি না)। প্রেশারকুকারের হিসহিস শব্দে অতীত থেকে আজকে ফিরে আসি।
এই নাগরিক জীবনে আমার বয়সীদের কাছে ঈদের দিনটি ভালো খাবার, ভালো কাপড়চোপড় পরে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কাটিয়ে একটু রেস্ট (আজকাল রেস্টের সময় আমরা কতটুকুই বা পাই!) নেওয়ার দিনই হয়ে দাঁড়িয়েছে বলা যায়।
ঈদে ঢাকা হয়ে পড়ে একেবারে ফাঁকা। ঢাকা খালি হয়, কারণ জীবিকার তাগিদে যাঁরা ঢাকায় আসেন, তাঁরা তাঁদের নিজ শিকড়ের কাছে ফিরে গেছেন বলেই (শিকড় ছাড়া কে-ই বা বাঁচে?)। সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা হয়, ঠিকমতো তাঁরা নিজ নিজ গন্তব্যে নির্দিষ্ট সময়ে নিরাপদে পৌঁছেছেন তো? তাঁরা তো আসলে একরকম বাধ্য হয়েই এখানে থাকেন, তাই না? ঈদের ছুটি আমাকে ভালোবাসার ঢাকাকে চিনিয়ে দেয় অন্য রকমভাবে। এ যে আমার চার্মিং ঢাকা । ঢাকাবাসী এ সময় ঈদ উপভোগ করেন, ফাঁকা ঢাকার রাস্তাঘাটও উপভোগ করেন। ঈদের সময় নিঃসঙ্গ ঢাকাই যে আমাদের ষোলআনা ঢাকা। তাকে যে বড্ড ভালোবাসি।