বাহের দেশেই বাস বাংলা ভাষার প্রাণভোমরার!
তত দিনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ৫০/৬০ বছর অতিক্রম করেছে। করলে কী হবে, এত দিনের ভাষা সরিয়ে দিয়ে সাহেবি বাংলা প্রতিষ্ঠা করা তো সহজ কম্ম নয়। সেকালে যদুনাথ সর্বাধিকারী নামে একজন ব্যক্তি 'তীর্থ ভ্রমণ' নামে একখানা গ্রন্থ লেখেন। এই গ্রন্থের সমালোচনায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লেখেন, ‘খ্রিস্টীয় উনিশ শতকের আরম্ভে তিন রকম বাংলা চলিত—১. ভট্টাচার্যদিগের বাংলা, ২. আদালতের বাংলা ও ৩. বিষয়ীলোকদের বাংলা। প্রথমটিতে টোলে যেসকল সংস্কৃত বই পড়া হয় সেই-সকল সংস্কৃত বইয়ের সংস্কৃত শব্দ অনেক থাকিত। দ্বিতীয়টিতে পারসি, আরবি ও উর্দু বেশি থাকিত। তৃতীয়টিতে সংস্কৃতও থাকিত, আরবিও থাকিত, পারসিও থাকিত, উর্দুও থাকিত, কিন্তি কিছুই অধিক পরিমাণে থাকিত না, কোনো কড়া শব্দ থাকিত না, যাহা দেশে প্রচলিত, যাহা সকলে বুঝিতে পারিত—সেই শব্দই থাকিত। যদুনাথের বাংলা খাঁটি এই বাংলা।’
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই মনে করেন, মধ্যযুগের কবিদের হাতে ভাষার যেরূপ দাঁড়িয়েছিল, তাহাই খাঁটি বাংলা। কিন্তু দুর্ভাগ্য ইংরেজ শাসনের বহুকাল পরে যখন মহাত্মাগণ বালিকে বাংলা শেখাতে উদ্যোগী হইলেন, আর তা করতে গিয়া তারা শরণ নিলেন সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতগণের। ফলে যাহা ফল হওয়ার তাহাই ফলিল। ফলে বাঙালির মুখের ভাষার সাথে চোখের ভাষার মিল হইল না, মাতৃভাষাকে বিদেশি ভাষার মত করি রপ্ত করিতে হইল, পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হইল।
প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস 'লোকসংগীত, উপভাষা, উপমা ও উচ্চারণ' প্রবন্ধে লিখেছেন, "অনেকদিন আগের কথা। কলকাতার একজন বাগ্মী নেতা আমাদের জেলায় এক কৃষক সমাবেশে সুদীর্ঘ ভাষণ দেবার পর সভায় উপস্থিত একজন বৃদ্ধ কৃষককে প্রশ্ন করেছিলেন, কেমন লাগল? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'নেতায় কইছুইন ভালা, খালি অত কইলকাত্তি না কইয়া যদি এট্টু বঙ্গভাষাত কইতা...।' বাংলা ভাষাটা আমাদের পূর্ববঙ্গের লোকদের কাছে কইলকাত্তি আর তাদের নিজেদের ভাষাটা তাদের কাছে 'বঙ্গভাষা'।...অথচ প্রতিবেশী অসমীয়া ভাষাতে এই বিচ্ছেদ দেখি না।...অসমীয়া গ্রাম্য প্রবাদ-প্রবচন, বাক্যভঙ্গি ও বিন্যাসকে আত্মস্থ করেই অসমীয়া সাহিত্য গড়ে উঠেছে। অসমীয়া ভাষায় বাংলা ভাষার মত সাধু ও চলিত, নাগরিক বিদগ্ধ ও গ্রাম্য কথ্য ভাষার মধ্যে কোনো বিশেষ ব্যবধান গড়ে উঠতে পারেনি। সেখানে অসমীয়া ভাষা সমস্ত অসমীয়া জনসাধারণেরই ভাষা।"
বিশ্বজনীন মানবাধিকারে মাতৃভাষায় শিক্ষা পাওয়া একটি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কারণ, তা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করা অসম্ভব। গির্জার সঙ্গে গ্যালিলিও গ্যালিলির যেসব কারণে বিপজ্জনক সম্পর্ক ছিল, তার একটি হচ্ছে ভাষার সম্পর্ক। তাঁর কালের পণ্ডিতদের মতো তিনি সব সময় লাতিনে লিখতেন না। তাঁর Dialogue ইতালীয় ভাষায় লেখা ও সহজ ভাষায় লেখা। তাঁর এই বই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে জনগণের মধ্যে চলে গিয়েছিল। ফলে গির্জার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ইতিহাসবিরোধী ভূমিকা জনগণের সামনে ন্যাংটা হয়ে যাচ্ছিল। এতে পোপ ও গির্জা কর্তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। লাতিন ভাষা ও সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জাতিরাষ্ট্র ও জাতীয় ভাষা গড়ে ওঠার মূলে এটাই ছিল যে, জনগণের বোধগম্য ভাষায় সবকিছু হতে হবে।
কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম ও সংস্কৃত কলেজের বাংলা বাঙালির কাছে বিদেশি ভাষা হয়েই রইল। তাহলে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি কোন মাতৃভাষা কায়েম করতে চেয়েছিল?
২.
বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অমিয়ভূষণ মজুমদার তাঁর রচনাবলির পঞ্চম খণ্ডের 'প্রাচীন কোচবিহারের ভাষা ও সংস্কৃতি' প্রবন্ধটিকে সাক্ষী মানছি। তিনি বলছেন, "প্রায় ৪০ বছর আগেকার কথা মনে পড়ছে। আমাদের পৈতৃক আবাস ছিল অবিভক্ত বঙ্গের মধ্যদেশে। পদ্মা পার হলে নদে, ব্রহ্মপুত্র পার হলে মৈমনসিং। নদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, এবং বাংলাদেশের সঙ্গেও। কোচবিহার থেকে যখন সেখানে যেতুম মনঃকষ্টের কারণ ঘটত—সমবয়সী আত্মীয় বলত, 'বাহে', বর্ষিয়সী এবং তৎকালে হিসাবে শিক্ষিতা আত্মীয়া বলেছিলেন, বেম্মকোচ।"
অর্থাৎ কোচবিহার সম্বন্ধে বাইরের লোকের ধারণা এটা বাহের দেশ বা বাহে ভাষার দেশ। কোচবিহার এখন একটি জেলা হলেও সে ছিল একটা রাজ্য। মাধবচন্দ্র অধিকারী তাঁর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে রাজবংশী সমাজ (১৯৪৭-৭৯) প্রবন্ধে এই রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে জানিয়েছেন, "কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, দার্জিলিংয়ের সমতল এলাকা, আসামের গোয়ালপাড়া, কামরূপ, নওগাঁও, ধুবড়ি কেলা, বিহারের পুর্ণিয়া ও কাটিয়ার জেলা, বাংলাদেশের রংপুর, পূর্ব দিনাজপুর, ময়মনসিংহ জেলার কিছু অংশ, লোয়ার ভুটান, মেঘালয়, নেপালের ভদ্রপুর, ঝাপা, মোরজেলা এবং ত্রিপুরার কিছু অংশ।" ফলে চর্যাপদ যে নেপালে পাওয়া গেল, তার ভাষাও তাই এই বাহের দেশের ভাষাই বলে মনে করা যুক্তিসংগত।
এ ছাড়া কোচ রাজসভার পণ্ডিতমণ্ডলীর সমাবেশ থেকে লেখা রত্নমালা ব্যাকরণ, রামায়ণ, মহাভারত, অষ্টাদশ পুরাণ, ভূমি পরিমাপ গ্রন্থ, মার্কেণ্ডেয় পুরাণ, ভাগবতের একাধিক স্কন্ধ অনুবাদ হলো, শ্রী শঙ্কবদেব এর ত্রিশখানা গ্রন্থও রচিত হয়েছিল যে ভাষায়, তা এই বাহের দেশের ভাষাতেই।
এবার সেইসব সাহিত্যের কিছু নমুনা হাজির হোক। ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মাধবদেব রামায়ণের আদিকাণ্ডের ভূমিকায় লিখেছেন :
"জয় জয় নরনারায়ণ হই নৃপকুল শিরোমণি।/ যাহার পরম প্রচণ্ড প্রতাপ ঢাকিল ইতো ধ্বনি।।/ সাগর পর্যন্ত ভূজন্তোক রাজ্য প্রজা করি প্রতিপাল।/ তৃষ্ণায় বকতি প্রচারি ইহন্তো জিয়ন্তোক চিরকাল।।"
আনুমানিক ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে পীতাম্বর সিদ্ধান্তবাগীশ লিখেছেন : "পুরাণাদি শাস্ত্রে এহি রহস্য আছয়।/ পণ্ডিত বুঝয় মাত্র অন্যে না বুঝয়।।/ এ কারণে স্লোক ভাঙ্গি সবে বুঝিবার।/ নিজ দেশ ভাষা বন্দে রচিয়ো পয়ার।।"
এ রকম নমুনা আমরা পরবর্তী শতকগুলোতেও পাবো। এবার কিছু গদ্য হাজির করা যাক। সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতদের গদ্য তৈরির ভার না পড়লে এই পত্রলেখকদের গদ্য জনগণের ভাষা হয়ে উঠতে পারত। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার থেকে লেখা চিঠির প্রথমাংশ এইরূপ ছিল : লেখনল কার্যঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্চা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্তব্যে সে বর্দ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিতাক হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগতে আছি। তোমারো এগোট কর্তব্য উচিত হয়। না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম। যতানন্দ কর্মী রামেশ্বর শর্মা কালাকেতি ও ধুমাসদ্দার উদ্ভণ্ড চাউনিয়া শ্যামরাই ইমরাক পাঠাইতেছি তামারার মুখে সকল সমাচার বুঝিয়া চিতাপ বিদায় দিবা।
আনুমানিক ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের কোচবিহারি ভাষার আরেকখানা চিঠি :
আতদসার গরদিস পত্রে কাতহাতক লিখিব—শ্রীসর্বানন্দ গোসাঞি আমাদিগের ঘরে২ বিভেদ বান্দাইয়া আমাদের ভূম হইতে বেদান্ত করিয়া লুটতরাজ করিয়া খানে ওযাবন করিল আমি চাইবসন হইলো নালিস মন্দ আমার ইনসাপ কেহ করে না, সন ১১৯৩ সালে শ্রীযুত গ্রেবোব সাহেব জিলা রঙ্গপুর পন্চীয়া বাবা শ্রীমান বিবেন্দ্রনারায়ণ জুবরাজকে তলব দিয়া লইয়া জাইয়া বৎস্বরাবাদি কাল রাখিল গোস্বাঞির কারসাজি মতে ইনসাপ না করিয়া বিদাএ হওনের কালে হুকুম করিল তুমি রাজার সহিত মিলওবে।
ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদগণ এই চিঠিকে মধ্যযুগের বাংলা ভাষার নমুনা বলে মত দিয়াছেন। অর্থাৎ ব্রিটিশপূর্ব বাংলা গদ্য জানতে গেলে বাহের দেশেই যেতে হবে।
৩.
জনগণের ভাষায় বাংলাকে গড়ে তোলা না গেলে আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য ও রাষ্ট্র সাধনা সবই মিছে হয়ে যাবে। নইলে অফুরন্ত সৃজনশীলতার উৎস জনগণকে রূপে-রসে-কল্পনায় সমৃদ্ধ করবেন কীরূপে?
উপায় আছে। বাহের দেশে একটা প্রবাদ আছে, সেটা হলো—গোড়া খাতায় হাত দেওয়া। কিংবা চর্যাপদের আবিষ্কর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশায়ের ভাষায় 'খাঁটি বাংলা' চালু করা। সেটাই বা কীরূপে সম্ভব? মাঝখানে তো আড়াইশ বছর ধরে ফোর্ট উইলিয়ামের গড়ি ভাষায় গড়াগড়ি খাচ্ছি, তার কী হবে?
নির্দিষ্ট একটা সময়ে লাতিন কীভাবে উচ্চারিত হতো তা ঠিকভাবে বলা কঠিন বা অসম্ভব। এটার ব্যাপারে পশ্চিমারা সমাধান খুঁজলেন—যাদের কোনো লাতিন টেক্সট উচ্চ স্বরে পড়তে বা গাইতে হয়, তারা একটি উচ্চারণেই স্থিত থাকেন। ঠিক তেমনি ভাওয়াইয়ার মতো প্রাচীন গান আমাদের আমাদের খাঁটি বাংলা গড়ার রাস্তাটা বাতলে দিতে পারে। আমাদের সৌভাগ্য, বাংলাদেশের ও কোচরাজ্যের গরিষ্ঠ জনগণ গরিষ্ঠ ভাষায় অভ্যস্ত নন। জনগণের এই ভাষা আমাদের লেখকদিগকে কান পেতে শোনা উচিত, অতপর লেখা উচিত।
সুকুমার রায়ের ভাষায়, লেখকদের পড়ালেখা নয়, পড়াশোনা করা উচিত। কারণ আমাদের উনিশশতকপর আগের বাংলা গদ্য-পদ্যের উদাহরণগুলোর সাথে ভাওয়ার উচ্চারণ ও বাক্য ভঙ্গির মিল আছে। ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে, কুনদিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে...। বাংলা ভাষার প্রাণভোমরাও এই বাহের দেশের ভাষাতেই লুকিয়ে আছে।
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি