রাষ্ট্রনীতি
বাজেট প্রণয়নে জনপ্রতিনিধি সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা
রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্যাবলিতে জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা পরিমাপের অন্যতম উপায় হলো রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহ ও বাজেট প্রণয়নে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কতটুকু ব্যবস্থা রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণের জন্য একটি সাংবিধানিক পদ রয়েছে। তা হলো মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। এই মহা হিসাব-নিরীক্ষকের নিয়োগ, অপসারণ, কার্যাবলি ও ক্ষমতা সংবিধানের ১২৭, ১২৮, ১২৯, ১৩০, ১৩১ ও ১৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা আছে। এ ছাড়া ১৩২ অনুচ্ছেদে ব্যবস্থা রয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের হিসাব সম্পর্কিত মহা হিসাব-নিরীক্ষকের রিপোর্টসমূহ রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি তা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করবেন। এবং ১৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে মহা হিসাব-নিরীক্ষক যা নির্ধারণ করবেন, সেই আকার ও পদ্ধতিতে প্রজাতন্ত্রের হিসাব রক্ষিত হবে।
মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক পদটি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত ও অপসারণযোগ্য বলে একজন মহা হিসাব-নিরীক্ষক রাষ্ট্রপতি তথা রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতার অপব্যবহার অথবা স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের বিরুদ্ধে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না।
একইভাবে বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীগণের ওপরে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের সীমাহীন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকায়, দলীয় ব্যক্তিদের সরকারি পদে নিয়োগ দিয়ে দল ও ব্যক্তির স্বার্থ হাসিলের সুযোগ তৈরি হয়। এ ছাড়া এই সকল পদে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তারা প্রায়ই জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকায় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের ওপরে জনগণের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ না থাকায় জন্ম হয় রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের। অথচ এ ধরনের আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধী। নিয়োগ পদ্ধতির জটিলতার কারণে দেশের সরকারি কর্মকমিশন বা অ্যাটর্নি জেনারেলের মতো পদগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে জনগণের পক্ষে তাঁদের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে এসব কর্মকর্তা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। কারণ সে রকম সাংবিধানিক সুযোগ খুবই সীমিত। তাঁরা বরং গণবিরোধী ভূমিকা পালনের সুবিধা ভোগ করেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের দ্বারা অনুরূপ বিধান না করা হইয়া থাকিলে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির সন্তোষানুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।’ সংবিধানের এই বিধান দ্বারা নিরপেক্ষভাবে জনগণের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের স্বাধীনতা ও আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করা হয়েছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে কারো নিয়োগ ও অপসারণে সংসদ সদস্যদের তথা জনপ্রতিনিধিদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব বিষয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ না থাকায় স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ইত্যাদি বিস্তারের সীমাহীন সুযোগ হয়েছে অবারিত।
সংসদ সদস্যদের ভূমিকা
এবারের বাজেট প্রণয়নে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্যরা কী ধরনের ক্ষমতা ভোগ করেছেন এবং কী ভূমিকা পালন করেছেন, তা বিশ্লেষণ করা যাক। আমরা সাধারণভাবে জানি, দেশের অর্থমন্ত্রী সরকারের পক্ষে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন্য বার্ষিক বাজেট পেশ করেন। কিন্তু আমরা জানি না, এ বাজেট কারা প্রস্তুত করেন এবং কীভাবে করেন। জাতীয় সংসদে পেশকৃত বাজেট গ্রহণযোগ্য না হলে সংসদ সদস্যরা সেই বাজেট প্রত্যাখ্যান করতে পারেন কি না; অথবা প্রত্যাখ্যান করলে এর ফলাফল কী হতে পারে- সেসব বিষয়ে দেশের নাগরিকদের ধ্যান-ধারণা সীমিত। অবশ্য এ বিষয়ে জানতে নাগরিকদের আগ্রহ খুব বেশি বলে মনে হয় না।
ফলে বাজেট পেশ ও পাশের বিষয়টি যে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারেন না। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জনগণের স্বার্থে কোনো বাজেট আদৌ প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। বাজেটের সংজ্ঞা নিয়ে এখানে বিশদ আলোচনার মধ্যে না গিয়ে শুধু এটুকুই বলা যথেষ্ট যে, সাধারণভাবে বাজেট মানে ক্ষমতাসীন সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বার্ষিক প্রতিবেদন। আর এই প্রতিবেদন সরকারের পক্ষে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে পেশ করেন। দেখা যাক, সংবিধানে বাজেট প্রণয়ন সংক্রান্ত কী কী বিধি-বিধান রয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে বাজেট সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধি-বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের আর্থ-প্রশাসন ৫ ভাগে বিভক্ত :
১. সংসদ
জাতীয় সংসদ ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী মূলত তিনটি দায়িত্ব পালন করে :
১.১ বার্ষিক বাজেট মারফত বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ বা কর্মপরিচালনার জন্য গণ-অর্থসংস্থানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের উদ্যোগের অনুমোদন;
১.২ নতুন কর ধার্য বা বিদ্যমান কর হারের পরিবর্তনের জন্য নির্বাহী বিভাগের সুপারিশসমূহ অনুমোদন;
১.৩ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি পরিদফতরের গণ-অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ।
২. অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে :
২.১ বার্ষিক বাজেট প্রস্তুতকরণ;
২.২ সংসদে বাজেট উপস্থাপনের লক্ষ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান;
২.৩ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বার্ষিক বাজেট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান;
২.৪ সরকারি রাজস্ব সংগ্রহ;
২.৫ বিভিন্ন প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় ও পরিদপ্তরকে আর্থিক শৃঙ্খলার প্রশ্নে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান। এবং
২.৬ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন মারফত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় বার্ষিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা।
৩. বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের মুখ্য হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাবৃন্দ
উল্লেখ্য যে, অর্থ মন্ত্রণালয় হচ্ছে বাংলাদেশের আর্থ-প্রশাসনের মুখ্য প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে গণব্যয়ের অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে। কিন্তু এ ছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সচিবরা সরকারের আর্থিক নীতিমালা ও অনুশাসনের সাপেক্ষে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়/বিভাগের জন্য গণব্যয়ের অনুমোদনের মুখ্য নির্বাহী কর্তৃপক্ষ বলে বিবেচিত হন। এসব ক্ষেত্রে তারা লক্ষ্য রাখেন মন্ত্রণালয়/বিভাগের ঘোষিত উদ্যোগের বিপরীতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা কার্যক্ষেত্রে যথাযথ সঙ্গতির সঙ্গে ব্যয়িত হয়েছে কি না।
৪. মহা হিসাব ও নিরীক্ষণ পরিদপ্তর
১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী মহা হিসাব ও নিরীক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব হচ্ছে, সরকারি কোষাগার থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও তা হিসাবের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া সংসদের কাছে গণব্যয়ের বিভিন্ন অসঙ্গতি ও দুর্নীতির বিষয়াদি তুলে ধরা।
৫. সংসদের বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটি
৫.১ গণহিসাব পর্ষদ : গণহিসাব পর্ষদ মহা হিসাব ও নিরীক্ষণ পরিচালকের হিসাব অনুযায়ী গণহিসাব পর্যবেক্ষণ এবং এ ক্ষেত্রে অসঙ্গতিসমূহ সংসদের গোচরীভূত করা ও তা প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে থাকে;
৫.২ এস্টিমেট কমিটি : এস্টিমেট কমিটি সরকারের বিভিন্ন দপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের অর্থ ব্যয়ে আর্থিক কৃচ্ছ্রসাধনের পরামর্শ দেন;
৫.৩ গণ-উদ্যোগ পর্ষদ : গণ-উদ্যোগ পর্ষদ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগসমূহে, যেমন সরকারি খাতের বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক কার্যক্রম পরীক্ষা করে দেখেন এবং তাতে অসঙ্গতি থাকলে সংসদকে অবহিত করেন।
৫.৪ অর্থ পর্ষদ : উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাজেট প্রণয়ন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে সংসদের তথা সংসদ সদস্যদের কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। অন্য কথায়, বার্ষিক জাতীয় বাজেট প্রস্তুতের প্রক্রিয়ায় সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রই মূলত প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের ধরন থেকে যেকোনো গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি বুঝতে পারেন বিদ্যমান রাষ্ট্রের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্কটা কেমন। অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দের সরকার যেসব ঋণ গ্রহণ করে, সেগুলোর বেশির ভাগই জাতীয় স্বার্থবিরোধী ও শর্তযুক্ত। যা জাতির জন্য কখনোই মঙ্গলজনক হয়নি। ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রায় অর্ধেকের জন্য অর্থের সংস্থান করা হয় বিদেশি ঋণ ও অন্যান্য সাহায্য গ্রহণের মারফত। এর পরের বছর থেকে এবারের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট পর্যন্ত সব বাজেটে বিদেশি ঋণকে বাজেটের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে না দেখিয়ে ঘাটতি বাজেট পেশ করা হয়। ঘাটতি মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের উৎস সাধারণত বিদেশি ঋণ বা প্রকল্প সহায়তা। যদিও বলা হয়, বাজেটের অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, কিন্তু কার্যত তা পুরো সত্য নয়।
এ সমস্ত বিদেশি ঋণ গ্রহণ ও তার জন্য শর্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকাটা পালন করে থাকে প্রধানত সামরিক ও বেসামরিক আমলারা। সংসদ সদস্যদের কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ মূলত অনুপস্থিত। অন্যদিকে, কোনো সামরিক ও বেসামরিক আমলা এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা কোনো মারাত্মক অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে, সে জন্য তিনি সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তাঁরা কেবল তাঁদের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কাছে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যের জন্য দায়ী থাকেন। সেক্ষেত্রেও জনপ্রতিনিধিরা কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না।
এ তো গেল বাজেট প্রণয়নের দিক। এবার আসা যাক, বাজেট অনুমোদনের ক্ষেত্রে কী কী সাংবিধানিক অনুশাসন রয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী সংসদ হচ্ছে সকল প্রকার আইন প্রণয়ন বা বিল অনুমোদনকারী সংস্থা। আমরা সাধারণ অর্থে যাকে বাজেট বলি তাকে সাংবিধানিকভাবে বলা হয়, বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন (Annual financial Statement)। সংবিধানের অধীন নিম্নোক্ত বিষয়াদি বলবৎ রয়েছে :
সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৮৭(২) অনুযায়ী বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিতে পৃথকভাবে :
“ক. এই সংবিধানের দ্বারা বা অধীন সংযুক্ত তহবিলের উপর দায়রূপে বর্ণিত ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এবং
খ. সংযুক্ত তহবিল হইতে ব্যয় করা হইবে, এইরূপ প্রস্তাবিত অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদর্শিত হইবে এবং অন্যান্য ব্যয় হইতে রাজস্ব খাতের ব্যয় পৃথক করিয়া প্রদর্শিত হইবে।”
এ ক্ষেত্রে সংযুক্ত তহবিল বলতে সংবিধানের ৮৪(১) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত সকল রাজস্ব, সরকার কর্তৃক সংগৃহীত সকল ঋণ এবং কোনো ঋণ পরিশোধ হইতে সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত সকল অর্থ একটি মাত্র তহবিলের অংশে পরিণত হবে এবং তা ‘সংযুক্ত তহবিল’ নামে অভিহিত হবে।” অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী সরকারের সকল প্রকার আয়কে বিবেচনা করতে হবে সংযুক্ত তহবিল হিসেবে। অনুচ্ছেদ ৮৮(ঘ) অনুযায়ী সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়যুক্ত ব্যয় হবে ‘সুদ, পরিশোধ-তহবিলের দায়, মূলধন পরিশোধ বা তাহার ক্রমপরিশোধ এবং ঋণ সংগ্রহ-ব্যপদেশ ও সংযুক্ত তহবিলের জামানতে গৃহীত ঋণের মোচন-সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয়সহ সরকারের ঋণ-সংক্রান্ত সকল দেনার দায়।’ অর্থাৎ সরকার কর্তৃক সংগৃহীত সকল প্রকার দেনা (কার্যত বিদেশি দেনাকেই বোঝানো যেতে পারে) পরিশোধের জন্য যে সমস্ত ব্যয় প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে (যেমন বিদেশি ঋণের সুদ ইত্যাদি) সে সমস্ত কিছুর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান সংযুক্ত তহবিল থেকে করা হবে। এখানে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনের যে অংশটি সাংবিধানিকভাবে Expenditute Charged upon the Consolidated Fund বলে ব্যাখ্যাত সেক্ষেত্রে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮৯(১) অনুযায়ী ‘সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয়-সম্পর্কিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির অংশ সংসদে আলোচনা করা হইবে, কিন্তু তাহা ভোটের আওতাভুক্ত হইবে না।’
১৯৭২ সালে প্রণীত বিদ্যমান সংবিধানের এই বিধান অনুযায়ী দেখা যায় যে, কার্যক্ষেত্রে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোনো প্রকার নাক গলানোর অধিকার জাতীয় সংসদের নেই। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, বিদেশি ঋণ ও মঞ্জুরি সংগ্রহ বা সংগ্রহের উদ্যোগ এবং এ সম্পর্কিত শর্তাবলি নির্ধারণ ও অনুমোদনের কর্তৃপক্ষ, সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নয়। এর পাশাপাশি আমরা চিহ্নিত করছি যে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপত্তি তোলার অধিকারও ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদের নেই। এ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, বিদেশি ঋণ গ্রহণ ও তা পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ‘সার্বভৌম নয়’ এ বক্তব্য বিদ্যমান সংবিধানের অধীন অসাংবিধানিক বলে বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন বা বাজেটের যে অংশটি Consolidated fund-এর সঙ্গে সম্পর্কহীন সে সমস্ত ব্যয় সম্পর্কে ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুশাসন হচ্ছে, ‘অনুচ্ছেদ ৮৯(২) : অন্যান্য ব্যয়-সম্পর্কিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির অংশ মঞ্জুরি-দাবির আকারে সংসদে উপস্থাপিত হইবে এবং কোনো মঞ্জুরি-দাবিতে সম্মতিদানের বা সম্মতিদানে অস্বীকৃতির কিংবা মঞ্জুরি-দাবিতে নির্ধারিত অর্থ হ্রাসসাপেক্ষে তাহাতে সম্মতিদানের ক্ষমতা সংসদের থাকিবে।’
সংবিধানের এই অনুশাসন থেকে মনে হতে পারে যে বাজেটের (সরকারের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন) অনুমোদন কিংবা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের রয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের ভুললে চলবে না, তা হলো, কোনো বাজেট সংসদ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলে যে সরকার বাজেট উপস্থাপন করে কার্যত তার পতন ঘটে। কারণ প্রজাতন্ত্রের আর্থ-প্রশাসন পরিচালনার আইনগত ভিত্তি তখন সে সরকার হারিয়ে ফেলে। ফলে ক্ষমতা থেকে সেই সরকারের পতন সাংবিধানিকভাবে অবশ্যম্ভাবী। এবং আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, সংবিধানের ৮৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয়-সম্পর্কিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির অংশ সংসদে আলোচনা করা হবে, কিন্তু তা ভোটের আওতাভুক্ত হবে না। সোজা কথায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বাজেট অনুমোদনে লোকদেখানো কণ্ঠভোটের ব্যবস্থা থাকলেও এর কোনো সাংবিধানিক মূল্য নেই।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য তাঁর নিজ রাজনৈতিক দলের নির্দেশ অমান্য করে ভোট দিতে পারেন না। অর্থাৎ বাজেট যেহেতু সরকারি দল কর্তৃক উপস্থাপিত হয় এবং সরকারি দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, যেহেতু বাজেট অনুমোদন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, সেহেতু কার্যক্ষেত্রে নিজ দলের এবং আপন সদস্যপদ রক্ষার স্বার্থেই সরকারি দলের সদস্যরা বাজেট অনুমোদনে বাধ্য। যেটুকু জাতীয় সংসদের সদস্যরা, বিশেষ করে সরকারি দলের সদস্যরা করতে পারেন, তা হলো, নিজ দলের সম্মতিসাপেক্ষে বাজেটে প্রস্তাবিত ব্যয় হ্রাসের সংশোধনী পেশ ও অনুমোদন করতে পারেন। কাজেই বাজেট প্রণয়ন ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার ওপর জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় অনুশাসন প্রদানে সংবিধান পুরোপুরি অক্ষম। এ অবস্থায়, জাতীয় সংসদকে রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু করার ঘোষণা বা কেন্দ্রবিন্দু করার বাসনা একটি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম : সভাপতি, গণতান্ত্রিক সংবিধান সংগ্রাম কমিটি এবং সদস্য, কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটি, গণসংহতি আন্দোলন।