প্রতিক্রিয়া
ম্যানচেস্টারে হামলা পরবর্তী শঙ্কা
আমরা ছিলাম আমাদের প্রবাস বাংলা অনলাইন টিভির গ্রান্ড ওপেনিংয়ে, ওল্ডহ্যামে। পাঁচ শতাধিক মানুষ এখানে উপস্থিত ছিল। সোমবার রাত পৌনে ১১টার দিকে ম্যানচেস্টারে বোমা হামলার কিছু সময়ের মধ্যেই এ খবর পৌঁছাল সেখানে। হতাহতের খবর তখনো আমাদের জানা হয়নি। আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়লাম, একটা বাঁকা দৃষ্টির মাঝে কাল থেকেই পড়তে হবে আমাদের। এই ভাবনাটা ছিল সবারই, যদি মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হওয়ার খবর আসে, তবে এ দায় কি দিয়ে শোধ হবে? অনেকটা স্তব্ধ হয়ে গেল আমাদের অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শহরের প্রতিনিধিত্বশীল মানুষের উপস্থিতি ছিল সেখানে। ঘোষণা শুনে সবাই শোক-বিহ্বল হয়ে যান। অনুষ্ঠানে নেমে আসে এক গভীর নীরবতা।
সঙ্গে সঙ্গে খবর না পাওয়া গেলেও ঘন্টা খানিকের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ল, ১৯ জন নিহত হয়েছে। আহতদের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। পরে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। রাতেই ফোন পেয়েছি শুভাকাঙ্ক্ষীদের। সকালে উঠেই দেখি ইয়ার সেভেনে পড়া আমার মেয়েটা উদ্বিগ্ন। তার বন্ধুরা গেছে ওই কনসার্টে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইন্সটাগ্রামে তারই বয়সীদের তিনশতাধিক ম্যাসেজ। সবাই উদ্বিগগ্ন। শুধু সাদা কিংবা ইংলিশ কমিউনিটি নয়, বাঙালি, পাকিস্তানি ছেলেমেয়েরাও ছিল সেখানে। এমনকি মা-বাবা কিংবা অভিভাবকরাও ছিলেন সঙ্গে। বাচ্চাদের অনুষ্ঠান দেখার সুবাদে আমিও এই গায়িকা-অভিনেত্রী আরিয়ানাকে চিনি। টিনএজারদের জন্য তৈরি একটা ধারাবাহিক নাটকের চরিত্রে যখন আরিয়ানা গ্রান্ড স্কুলছাত্রী হয়ে কথা বলে, তখন তার উচ্চারণ থাকে অস্বাভাবিক। ধারাবাহিকে ওই তারকা কথা বলেন নাকি সুরে। সেজন্যেই তাকে আমি চিনি। আমার মেয়েরাই তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আমাকে, বলেছিল সে এক বিখ্যাত গায়িকা এবং খুবই জনপ্রিয়। এই মেয়েটার কনসার্ট ছিল ম্যানচেস্টারে। কনসার্ট শেষে বেরোবার সময় আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী নিজেকে ইতিহাসের এক ঘৃণিত পাশবিক মানুষ হিসেবে প্রমাণ করে কেড়ে নিয়ে নিল মোট ২২টি প্রাণ। ধারণা করা হচ্ছে এদের বেশির ভাগই ২০ বছরের নিচের ছেলেমেয়ে হতে পারে। প্রথম যে নামটা এসেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে এই মেয়েটিও হচ্ছে সাফি রউজ নামের আট বছরের স্কুলছাত্রী এবং আরেকজন হলো জরজিনা ক্যালেন্ডার, যার বয়স ১৮ বছর। আহতদের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১২০ জন।
২৩ মে খুব সকাল থেকেই এ নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। বাঙালি কমিউনিটিতে আছে এ নিয়ে শঙ্কা। তবে এনিয়ে সাহসী উচ্চারণ আছে কমিউনিটিতে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তরুণ বাঙালি কাউন্সিলর লুৎফুর রহমান, যিনি সিটি কাউন্সিলের আর্ট কালচার ও ইয়ুথ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তাঁর সঙ্গে আলাপকালে তিনি ঘটনার নিন্দা জানান। বলেন, ‘এটা শুধু বাঙালি কমউিনিটির সমস্যা নয়। সবার সমস্যা। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করব।’ বিকেল ৬টায় নিহতদের স্মরণে যে স্মরণ সমাবেশ হয়েছে, টাউন হলে, সেখানে ম্যানচেস্টারের সব মানুষের সঙ্গে তার এলাকার বাঙালি-পাকিস্তানিদের উপস্থিত থাকার জন্যে অনেককেই অনুরোধ করেছেন তিনি। বাঙালি স্থানীয় মসজিদ শাহজালাল মসজিদ থেকে সকালেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঘটনার নিন্দা জানানো হয়েছে। এ ঘটনার পরপর মানবিক সহায়তায় ম্যানচেস্টারে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ঘটনার পর পরই মধ্যরাতে স্থানীয় হোটেলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি গ্রাউন্ডে একটা জায়গা খুলে দেওয়া হয়েছে। স্বজন বিচ্ছিন্ন মানুষরা এখানে এসেছেন। ম্যানচেস্টারে থাকা-খাওয়া যোগাযোগ সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রভাবশালী দৈনিক ইভিনিং নিউজ কর্তৃপক্ষ নিহত-আহতদের সহায়তায় পাঁচ লাখ পাউন্ড সংগ্রহ করার ঘোষণা দিয়ে ২০ ঘণ্টার মধ্যেই সংগ্রহ করেছে অর্থের ৮৫ ভাগ। শিশু হাসপাতালসহ আটটি হাসপাতালে প্রাধান্য দিয়েই পরিচর্যা চলছে আহতদের। একটা মানবিক কাজ করেছে স্থানীয় একটা ট্যাক্সি কোম্পানি। তারা ঘোষণা দিয়েছিল তারা যেকোনো মানুষকে তাৎক্ষণিক সুবিধা দেবে। ট্যাক্সি ড্রাইভাররা সবাইকে সহায়তা দিয়েছে। অর্থ ছাড়াই মানুষকে পৌঁছে দিয়েছে যার যার গন্তব্যে। উল্লেখ্য স্থানীয় ট্যাক্সি কোম্পানিতে বাঙালি-পাকিস্তানিদের আধিক্য আছে। এই ব্যাপারটা ব্রিটেনের মূলধারায় আলোচিত হচ্ছে। এটি কমিউনিটির জন্য একটি ইতিবাচক দিক।
২.
২২ মার্চ ২০১৬তে ব্রাসেলসে সংঘটিত হয়েছিল এ রকমই এক সন্ত্রাসী হামলা, ৩২ জন নিহত হয়েছিলেন সেদিন। ব্রাসেলসে ওই হামলার বর্ষপূর্তিতে আলোচনা চলছিল ব্রিটেনের সারা মিডিয়ায়, এ বছরের ২২ মার্চ। সেদিন আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই মধ্য দুপুরে গণমাধ্যমসহ সবখানেই নতুন শিরোনাম হয়েছিল- ব্রিটেনের পার্লামেন্ট ভবন আক্রমণের চেষ্টা। এক উন্মাদ খুনি, ভাড়া করা গাড়ি চালিয়ে দেয় পথচারীদের ওপর। পুলিশসহ নিহত হলেন পাঁচজন। ব্রিটেনে এরই মধ্যে দুই একটি বর্ণ-বিদ্বেষী হামলাও হলো। ঠিক সে সময়েই অর্থাৎ পরের দিন ব্রাসেলসে একই কায়দায় হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চাইল আরেক আফ্রিকান বংশোদ্ভূদ ফরাসি নাগরিক । একটা ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকায় ব্রিটেনের তথাকথিত ধর্মান্তরিত খালেদ মাসুদের মতোই সেও পথচারীদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়। কিন্তু ম্যানচেস্টারে এবারের আক্রমণটা ভিন্ন । কনসার্ট শেষে সবচেয়ে বেশি মানুষের বের হওয়ার পথটাকেই বেছে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। কারণ সন্ত্রাসীরা জানত সিকিউরিটি ভেদ করা কোনোভাবেই তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই বাইরেই হয়তো অপেক্ষা করছিল নৃশংস ওই উন্মাদ। উন্মাদের নাম প্রকাশ করেছে মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থা। লিবীয় বংশদ্ভূত ম্যানচেস্টারে জন্ম নেয়া সালমান আবেদী নামের নৃশংস ঐ ব্যক্তিটিই ঘটিয়েছে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। পরের দিন অর্থাৎ ২৩ মে বিভিন্ন জায়গা থেকে অন্তত ২টা বোমা উদ্ধার এবং কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই সেগুলো অকার্যকর করেছে পুলিশ।
এভাবেই পৃথিবীর দেশে দেশে যেন সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চাইছে। প্রতিবছরের কোনো না কোনো সময় যেন একেকটা বেদনাবিধূর ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে পৃথিবীর মানুষদের। সিরিয়ায় আইএসের পতন কিংবা ধস নামার পর তারা যেন আরো বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ধর্মের নামে চালাচ্ছে সন্ত্রাসী আক্রমণ। আর পৃথিবীটাকে পরিণত করে তুলছে আতঙ্ক আর সন্ত্রাসের জনপদ। ইতিমধ্যে আইএস এই নৃশংস ঘটনা ঘটানোর দায় স্বীকার করেছে। স্বাভাবিকভাবেই আবারও মুসলিম শব্দটাই ফিরে আসছে। শঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে কোনো না কোনোভাবেই প্রত্যেকটি ঘটনায় ফিরে ফিরে আসছে মুসলিম সন্ত্রাসীদের নাম। এদের মাঝে আরব,আফ্রো-ক্যারাবিয়ান,পাকিস্তানিদের পাশাপাশি বাঙালিদের নামটাও কোনো না কোনোভাবে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে।
৩.
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে মঙ্গলবার দুপুরের আগেই ম্যানচেস্টারে পৌঁছেছেন। দেশের জরুরি সময়ে অনুষ্ঠিত হয় যে কোবরা মিটিং, প্রায় এক ঘণ্টার এই জরুরি সভা শেষে তিনি বলেছেন, পুলিশ ও নিরপত্তা কর্মীরা জানে কারা ওই আক্রমণকারী, তবে তারা এখন পরিচয় জানাবে না। ইতিমধ্যে একজনকে আটক করা হয়েছে। ২৩ বছরের ওই মানুষটির নাম আমরা এখনো জানি না । ব্রিটেনের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যতক্ষণ এই মানুষের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত না হবে, ততক্ষণ এই নামটার হয়তো আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেবে না। মিডিয়াও এ নিয়ে গল্প ফাঁদবে না।
আটককৃত এই তরুণের নাম আসুক আর না আসুক, মিডিয়ায় এ নিয়ে আলোচনা এই মুহূর্তে হোক কিংবা না হোক, ব্রিটেনে চলছে এখন সব শ্রেণির মানুষের এক অনিঃশেষ ক্রন্দন। ম্যানচেস্টারের কনসার্টে যে শিশু-তরুণ-তরুণিরা এসেছিল, তাদের ২২টি প্রাণ ফিরে যেতে পারেনি তাদের গৃহে। আমাদের স্বীকার করতেই হবে, এই নাগরিকদের মাঝেও ফনা তোলা আইএসের বিষধর জন্তুরা ওত পেতে আছে। আমাদের রুখতেই হবে এদের। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আবারও জড়ো হতে হবে মানুষের কাফেলায়।
লেখক : প্রবাসী, ম্যানচেস্টার, যুক্তরাজ্য