অভিমত
কেন আলোচনায় বিমানবন্দর সড়কের ৪ ফিট দেয়াল
ফেইসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলমান ‘বনসাই’ সমস্যার সমাধান দিয়েছে একটি লেখা, যার শিরোনাম ‘ বিমানবন্দর সড়কের বনসাই এবং আমাদের সাংবাদিকতা’। শুধু তাই নয় বিমান বন্দর সড়কের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার সমাধানও দিয়েছে সেই লেখা।
এই জন্য একজন নাগরিক হিসেবে সেই লেখাটির জন্য লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলেই নয়। তবে , ঘটনা প্রবাহে মনে হচ্ছে : এ প্রকল্প নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবারও নতুন ‘ইস্যু’ এ প্রকল্পের চার ফিট দেওয়াল। সেই দেওয়ালের কারাগারেই নাকি আটকা পড়ছে রাজধানী ঢাকা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবারও ছড়িয়েছে উত্তাপ। তবে , যিনি এ মন্তব্য করে ঢাকা সিটিতে উত্তাপ ছাড়িয়েছেন তার সেই উত্তাপে নগরবাসীর আতঙ্কিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই । তবে একটু যারা বিশ্লেষণ করবেন তারা অবশ্য আতঙ্কিত না হয়ে আশ্চর্য কিংবা কিংকর্তব্যবিমুড়ও হতে পারেন।
ঢাকা সিটির আয়তন প্রায় ৩০২ দশমিক ৪ কিলোমিটার। কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে বিমান বন্দরের দূরত্ব চার কিলোমিটার। এই রাস্তার পাশে চার ফিট দেওয়াল তৈরি করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। এবার দেখি কারাগারের দেওয়ালের উচ্চতা কত? কারাগারের দেওয়ালের উচ্চতা হয় ১৮ ফুট। এবার আসুন অঙ্ক মেলাই চার কিলোমিটারের চার ফুট দেওয়াল দিয়ে ৩০২ দশমিক ৪ কিলোমিটার আয়তনের ঢাকাকে কারাগারে পরিণত করি। এর আগের অঙ্কে আমি ফলাফল কিন্তু চাইনি। তাই এবারও চাইছি না।
কিন্তু যিনি আজ সকালে কারাগারে ঢাকা সিটি বলে নগরবাসীকে উৎকণ্ঠায় রেখে গেছেন হিসাবটা তার জন্য রেখে দিলাম।
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে। এটা রাজধানীর মোটামুটি সবারই জানা। ছয় কিলোমিটার এ সড়কে সাড়ে পাঁচ লাখ গাছ লাগাবে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ভিনাইল ওয়ার্ল্ড। এরই অংশ হিসেবে কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত রেললাইনের পাশের অংশে চার ফিট উচ্চতার দেওয়াল তৈরি করা হচ্ছে। সবুজায়নের অংশ হিসেবে এ দেয়াল এক ধরনের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। যাকে বলা হয় ওয়াল কার্পেট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন আছে।
আমাদের দেশের কোনো রাস্তার পাশে যে দেওয়াল তৈরি করা হয়নি তা নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বাইপাস সড়কটিতে ৪-৫ ফিট উচ্চতার দেওয়াল তৈরি করে তার পাশে গাছ লাগানো হয়েছে। আর হাতিরঝিল প্রকল্পের জন্য এলাকার চারপাশে ৮-১০ ফিট উচ্চতার দেয়াল দেওয়া হয়েছে। এরকম রাজধানীতে আরো অনেক জায়গা আছে যেখানে রাস্তার পাশে দেওয়াল আছে।
তারপরও কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের পাশে দেয়াল তোলায় সমস্যা কোথায়। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলতে পারছি না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। অবারিত সবুজ ঢেকে যাবে তাই এ রাস্তার পাশে দেয়াল তৈরি করা বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। আগের মতো অঙ্কের হিসাবে আর না যাই। তবে একটা উদাহরণ দেই। অন্য রাস্তা বাদই দিলাম। একই সড়কের মাঝে রোড ডিভাইডারের উচ্চতা সাড়ে তিন ফিট। প্রশ্ন হলো সাড়ে তিন ফিট এই রোড ডিভাইডারের কারণে অবারিত সবুজ ঢেকে যায় কি না। এবারও আমি উত্তর চাচ্ছি না।
তাহলে কেন আসছে এ দেয়াল প্রসঙ্গ। কেন বলা হচ্ছে এই দেয়ালের কারণে ঢাকা কারাগারে পরিণত হচ্ছে। নিতান্তই একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেখতে চাই এ দেয়াল হলে কী লাভ আর না হলে কী ক্ষতি।
লাভের হিসাবটা আগে করি। বিমানবন্দর সড়কের মূলত এই জায়গাটি তুলনামূলক নির্জন। খিলক্ষেত পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ছিনতাই প্রায় নিয়মিত। পাশাপাশি রয়েছে এ এলাকার বস্তি কেন্দিক মাদক ব্যবসা। যে এলাকায় দেয়াল তৈরি করা হচ্ছে তার পাশেই রয়েছে রেললাইন। রেলওয়ে পুলিশের তথ্যমতে প্রতি বছর এখানে কাটা পড়ে ৩০-৩৫ জন। দেয়াল থাকায় এ এলাকায় ফুটওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার কমবে। দেয়াল ঘেষে থাকবে ১২টি পুলিশ বক্স। প্রতি এক কিলোমিটার পর পর থাকবে এ পুলিশ বক্সগুলো।
এবার ক্ষতির হিসাবটা করি। এলাকার ছিনতাইকারীরা বেকার হয়ে পড়বে। মাদক ব্যবসায় দেখা দিবে মন্দা। রেলে কাটাপড়া কমে গেলে পাশের হাসপাতাল রোগী পাবে না। রেলওয়ে পুলিশকে রেওয়ারিশ লাশ টানতে হবে না। নিরাপত্তাহীনতায় স্বাদ পাওয়া যাবে না। নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হওয়া যাবে না।
লাভ-ক্ষতির হিসাব যাই হোক পাঠক আসুন মূল আলোচনায় ফিরে যাই। যে সবুজ দেয়ালের কথা বলা হচ্ছে। যে ল্যান্ড স্কেপিংয়ের কথা বলা হচ্ছে। যে সাড়ে পাঁচ লাখ গাছের কথা বলা হচ্ছে। তা যখন বাস্তবে রূপ নেবে আপনি পাঠক নিজেকে ওই জায়গায় ভাবুন। তারপর দেয়াল ভাঙার দাবি নিয়ে কথা বলুন।
আমি গত বছর এই সময় টোকিও ছিলাম। আর পাঠক আপনারা যারা টোকিও আছেন বা যারা টোকিও ভ্রমণ করেছেন নিশ্চই দেখেছেন তাদের প্রতিটি মহাসড়কের দুই পার্শে রয়েছে ১২-১৪ ফুট দেয়াল। যদিও সেটা অসচ্ছ কাঁচের।
জাপানের মতো উন্নত একটি দেশে এ ধরনের দেয়াল দেখে আপনি নিশ্চই অবাক হননি বা আশা করছি হবেন না। তাহলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে শতাধিক ফুল এবং বাহারি গাছের ল্যান্ড স্কেপিংয়ের পাশে চার ফিট উচ্চতার এ দেয়াল আসলেই কি বেমানান।
বিমান বন্দর সড়কের চার কিলোমিটার এলাকায় চার ফিট উচ্চতার দেয়াল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা মিডিয়াপাড়া গরম করা বা করার যাঁরা চেষ্টা করছেন, আসুন যুক্তির নিক্তিতে পরিমাপ করে সমালোচনা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই। আর কোনো ব্যাপারে যুক্তি দিতে না পারলে আসুন ভালো কাজের সমালোচনা থেকে বিরত থাকি।
লেখক : অনলাইন এক্টিভিস্ট