রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি
বিপর্যয়ের শেষ কোথায়?
দেশে ঘটমান যেকোনো ট্র্যাজিক ঘটনা মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়ার খুব সহজ একটা পদ্ধতি আছে। এক করুণ ইস্যুকে চাপা দিয়ে দিতে হয় অন্য কোনো মারাত্মক বা অভিনব নতুন ঘটনা দিয়ে। তাজরীন ফ্যাশনের ভয়াল আগুন ঢাকা দিয়ে যায় রানা প্লাজা। তারপর একসময় তাজরীনের আগুনও তার ধার হারিয়ে ফেলে নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আমরা সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার আগের মতো সজীব-সতেজ হয়ে যাই; কারণ আমরা বাঙালিরা গোল্ডফিশের মতোই বেশ ভুলোমনা জাতি।
বৈশ্বিকভাবে উদাহরণযোগ্য ও ব্যাপক সমালোচিত মানবীয় বিপর্যয়ের ঘটনা রানা প্লাজা ধসের চার বছর হলো আজ। আমরা এই ঘটনার কতটুকুই বা হৃদয়ে গেঁথে রাখতে পেরেছি? দীর্ঘদিন না খেয়ে বাঁচা রেশমার নাটকীয় উদ্ধার, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পাওয়া নূপুর পরা পা কিংবা কোনো দম্পতির শেষ আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবি এবং মিনিস্টারের পিলার ঝাঁকুনির রসালো আলাপ ছাড়া আর কী-ই বা আমরা মনে রাখতে পেরেছি? এখনো রানা প্লাজার বিপর্যয়ে পড়ে সুবিধাবঞ্চিত শত নিষ্পেষিত মানুষ তাঁদের রোজকার হাহাকার আর আহাজারিতে মানবীয় বিবেককে প্রশ্নের সম্মুখীন করে যাচ্ছে, তার খবর রাখছে কয়জনা?
প্রান্তিক মানুষকে জীবিকা করে ফুলে-ফেঁপে ওঠা সাভারের ভবন মালিক সোহেল রানা ও তাঁর সহযোগীদের শাস্তির আওতায় আনা যায়নি চার বছরেও। দুর্ঘটনার ধকল সয়ে যাঁরা কোনোরকমে নিজেদের প্রায় নিঃশেষ হওয়া প্রাণকে বয়ে চলেছেন এবং যাঁরা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন, সেই শ্রমজীবীদের পরিবারের ভাগ্যে জোটেনি সহায়তার চারআনাও; বরং জীবিতদের নানা অজুহাতে দিন দিন ফেলে দেওয়া হচ্ছে সমূহ দুর্বিপাকে। নিহত শ্রমিকদের স্বজন এবং আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা প্রতিবাদের নিভু নিভু প্রদীপটা কিঞ্চিৎ জ্বালিয়ে রেখেছেন আর সংবেদনশীল গুটি কয়েক মানুষ তাঁদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। না হলে এই মর্মন্তুদ ঘটনা এত দিনে বেমালুম ভুলে যাওয়াও অসম্ভব কিছু ছিল না!
আমাদের নীতিনির্ধারকরা হয়তো ধরেই নিয়েছেন, শ্রমিকের আবার ন্যায্য পাওনা কী? তাঁদের অধিকারপ্রাপ্তির জন্য আইনের কাঠামোটাই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা। শ্রমিকের জন্য না আছে মজুরি বোর্ড, না আছে অধিকার আদায়ের সংঘ ট্রেড ইউনিয়ন। কাজেই শ্রমিককে আমরা যা বলাতে চাই, তারা তোতা পাখির মতো তাই বলে যেতে বাধ্য হয়।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভবনধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তিন হাজার ৬৬৫ জন মানুষকে জীবিত ও মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে এক হাজার ১৩৫ জনকে মৃত এবং দুই হাজার ৪৩৮ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ওই দিন নিহত হতভাগ্য মানুষের মধ্যে ১০৫ জনের পরিচয় এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তাঁদের পরিচয় আদৌ আর মিলবে কি না, সে বিষয়েও রয়েছে গভীর সংশয়।
রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল গঠন করা হয়েছিল। যেখানে জমা পড়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অনুদানের ১২৭ কোটি টাকা। সেই টাকা থেকে মাত্র ১৯ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, বাকি রয়ে যায় ১০৮ কোটি টাকা। জমা পড়া টাকা যদিও ডোনারদের প্রতিশ্রুত টাকার চেয়ে বেশ কম ছিল। অসহায় শ্রমিকের প্রতি এমন অবহেলা বিশ্বের আর কোথায় আছে জানা নেই!
রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিক বা নিহতের স্বজনদের জন্য সরকারি তরফে দৃশ্যমান সুনির্দিষ্ট কিছু করা হচ্ছে, এমন দৃশ্য আজ আর চোখে পড়ে না। অসহায় পোশাক শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় নির্লিপ্ততায় কিছু বেসরকারি সংগঠন এখনো তাদের কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন জরিপ করছে, গবেষণা করছে। কিন্তু সেসব আমলে নেওয়ার ফুরসত সরকারের আছে কি না, এই চার বছরেও তা পরিষ্কার অনুধাবন করা যায়নি।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চার বছর পূর্তির প্রাক্কালে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির পক্ষ থেকে ‘আ থাউজ্যান্ড ক্রাইস’ শিরোনামে ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে। যেখানে শ্রমিকদের কাছ থেকে শোনা বয়ান এখন পড়তে পারবে গোটা বিশ্ব। ইংরেজি ভাষার এই ওয়েবসাইট থেকে আহত শ্রমিকদের ছবি, তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প নিমেষেই জানা যাবে।
অন্যদিকে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতা সংস্থা অ্যাকশনএইড রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত ও নিহত পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চতুর্থবারের মতো ফলোআপ জরিপ করেছে। সেই জরিপের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, সাভারের ওই ভবন ধসের ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৪২ শতাংশ এখনো বেকার রয়ে গেছে।
এখনো বেশ কিছু সহায়সম্বলহীন নারী শ্রমিককে চিকিৎসার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হচ্ছে। মাসের মাসের পর মাস গেলেও কেউ কেউ নিয়মিত ওষুধ পাচ্ছে না। আহত শ্রমিকদের অনেকের চাকরি থাকলেও বিনা কারণে চাকরিচ্যুতির মতো ঘটনাও ঘটছে। কয়েকশ শ্রমিককে এমনতর মানবেতর জীবনযাপন করতে হলেও দায়িত্বশীলদের নজরে তাঁরা পড়ছেন না।
বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ধসের চার বছর পূর্তি হলেও বেঁচে যাওয়া শ্রমিক ও নিহতদের স্বজনদের বিভিন্ন সভায়, মিছিলে-মিটিংয়ে চিৎকার করে বলে যেতে হচ্ছে, এত দিন পার হলেও এ ঘটনার কোনো বিচার না হওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ! কেউ পা-হীন, হাতহীন হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। কেউ বা মাথায় আঘাত পেয়ে স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিও হারিয়েছেন। বেশ কিছু পরিবার তাদের নিখোঁজ স্বজনদের মরদেহটার সন্ধান পর্যন্ত পাননি। অথচ এমন বঞ্চিত মানুষদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কোথায় কেউ নেই। কিছু বেসরকারি সংস্থা নানা কর্মযজ্ঞ নিয়ে রানা প্লাজার শ্রমিকদের ভাগ্যবদলের কথা বলে গেলেও সমাজের বিত্তবান, ক্ষমতাশীল এবং খোদ রাষ্ট্রীয় নির্বিকারতা সব সুশীল, সভ্য, মানবতাবাদী ও সংবেদনশীল মানুষকে যারপরনাই অবাকই করছে! প্রশ্ন এখন এটাই, রানা প্লাজা বিপর্যয়ের তবে শেষ কোথায়? এমনটাই কি শ্রমিকদের নিয়তি?
শিল্পী ভূপেন হাজারিকা উদাত্ত সুরে জানিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষ মানুষকে পণ্য করে/ মানুষ মানুষকে জীবিকা করে/ পুরোনো ইতিহাস ফিরে এলে/ লজ্জা কি তুমি পাবে না ও বন্ধু/ মানুষ মানুষের জন্য/ জীবন জীবনের জন্য! তারপর ভূপেন তাঁর শ্রেষ্ঠ বাংলা গানে প্রশ্ন রেখেছিলেন, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু!
রানা প্লাজা ধসে দুর্বিপাক ও দুর্দশায় পড়া মানুষেরা সহানুভূতিশীল কার হাত ধরে তাঁদের অথৈ নদী পার হবে? এমন কেউ আছেন? মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য এই আপ্তবাক্যটি ভুলে গিয়ে আমরা কি চাই আরেক ভয়াল ইতিহাস এসে এই বাংলা ভূমির বিবেকহীন মানুষকে পর্যুদস্ত করে দিক? না চাইলে, আসুন বোধ জাগিয়ে রাখি আর ভালোবাসা দিয়ে মানুষ বাঁচিয়ে রাখি, মমতা দিয়ে অসহায়ের দুঃখ ঘোচাই।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।