অভিমত
এতে মুসলমানদের লাভ না ক্ষতি?
বৈশাখী ঝড় যেন কিছুতেই থামছে না। বিশেষ করে পয়লা বৈশাখ উদযাপন ও মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে হেফাজতি নিম্নচাপ দিন দিন বেড়েই চলছে। বাঙালি জাতি তো ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রের যে বড্ড অভাব। কারণ সরকার তো হেফাজতকেই আশ্রয় দিয়ে কুল পাচ্ছে না!
বুধবার রাতে একটি বেসরকারি চ্যানেলে টক শোতে হাজির হয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। আলোচনার বিষয় ছিল ‘হেফাজত বিতর্ক’।
ঘুরেফিরে আলোচনায় পয়লা বৈশাখ, ভাস্কর্য ও মঙ্গল শোভাযাত্রা। কী আশ্চর্য সবকিছুরই বিরোধী হেফাজতে ইসলামের ওই নেতা। সঙ্গে অনেক নতুন কথা শোনালেন, যা আগে খুব একটা শোনা যায়নি।
একবার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ওয়াজ শুনেছিলাম। বলেছেন, ‘সারা দিন খালি ডাকে এসো হে বৈশাখ এসো এসো..এ জন্যই তো চারদিক কালো করে বৈশাখী ঝড় আসে।’ কথায় যুক্তি আছে বটে! হায় রবিঠাকুর! আপনার ক্ষমতা আপনি দেখে যেতে পারলেন না। শুনেছিলাম তানসেনের গানে নাকি বৃষ্টি নামত, আপনার গানে দেখছি ঝড় নামে! কাল বোশেখি ঝড়।
এবার সেই গানে নতুন করে হিন্দুয়ানি খুঁজে পেলেন হেফাজতে ইসলামের নেতা। আপত্তি তুললেন, ‘অগ্নিস্নানে শুচি হউক ধরা’ নিয়ে। ব্যাখ্যা করলেন, এটা হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস, আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়-খার করে দিয়ে সেটাকে পরিষ্কার করে দেওয়া। এটাকে তিনি হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসীদের মৃত্যুর পর শবদাহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই ব্যাখ্যা শুনে কি মনে হবে আপনার? শুধু একবার গানের লাইনগুলো মিলিয়ে নিন কী বলেছেন রবীন্দ্রনাথ :
‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশ রাশি/ শুষ্ক করি দাও আসি
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ
মায়ার কুজঝটিজাল যাক, দূরে যাক যাক যাক /এসো এসো
এসো হে বৈশাখ এসো এসো ’
আমাদের দেশের অনেকের মধ্যেই বিশ্লেষণী ক্ষমতা এত বেড়েছে যে, তারা শব্দের মধ্যেও ইদানীং হিন্দুয়ানি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ফলে অগ্নিস্নানের মতো প্রতীকী শব্দের ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যা তৈরি হচ্ছে। শুনেছি সোনা খাঁটি করতেও নাকি তাকে আগুনে পেড়াতে হয়। এখন আমি যদি বলি সোনাকে অগ্নিস্নান করাতে হয়, তাহলে গয়নাগুলো কি হিন্দুয়ানি হয়ে যাবে। আমাদের বুঝতে হবে একই শব্দকে নানাভাবে ব্যবহারের সুযোগ আছে। কখনো একটি শব্দের মাধ্যমে আমরা ভিন্ন কিছুকেও তুলনা করি।
ইসলাম ধর্ম এত ঠুনকো নয় যে একটা শব্দেই তা নষ্ট হয়ে যাবে। আমার মনে আছে ছোটবেলায় আমাদের অনেক প্রতিবেশী হিন্দু ছিল, যাদের ঠাকুর ঘরে ঢোকা একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সেটা করত আগের প্রজন্ম মানে আমার বন্ধুদের দাদা-দাদুরা। মনে পড়ে আমার বন্ধু হিরণ, রিপন বা শিশিরের ঠাকুরঘর অব্দি আমার যাওয়া-আসা ছিল। তাই কোনো শব্দে, কোনো বাঙালি উৎসবে তার পবিত্রতা নষ্ট হবে, এটা আমি মানতে নারাজ। মনে আছে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের জাতের বজ্জাতি কবিতার লাইনগুলো?
‘জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল
তাই কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁয়া ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল
যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত
আজ না হয় কাল ভাঙবে সে তো’
কবি, দার্শনিক, তাত্ত্বিক লালন সাঁই তো কতভাবেই না বলার চেষ্টা করেছেন চিহ্ন বা আচার নয়, মানুষই বড় কথা, মানবতাই বড় কথা। ‘ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি, এক জলেতে হয়রে শুচি, দেখে শুনে হয় না রুচি, যম তো কাকেও ছাড়ে না’।
যম হয়তো কউকেই ছাড়বে না। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যে যম আমাদের প্রতিদিন একটু একটু করে মেরে ফেলছে তার কী হবে? টকশো অনুষ্ঠানে মুফতি ফয়জুল্লাহকে যখন বলা হলো, রবীন্দ্রনাথ তো হিন্দু নন। তিনি তো ব্রাহ্ম। হুজুর শুনলেন ব্রাহ্মণ। তিনি বুঝতেই চাইলেন না ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্ম এক নন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই মূর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন। তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী। তাঁর গানেও কোনো দেব-দেবীর আরাধনা তিনি করেননি। আবার হিন্দু ধর্মের লোকজন তো রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে ধর্ম-আচার পালন করে। তাতে কি জাত যায়? তো সমালোচনা অবশ্যই ভালো, ভুল ধরার অধিকার সবারই আছে, কিন্তু ভুল ধরতে গিয়ে আমরা যদি বড় ভুল করে ফেলি, সে ভুলের মাশুল দেওয়া সত্যি কঠিনই বটে।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিবের আপত্তি লাল-সাদা শাড়ি নিয়েও। সেখানেও তিনি সিঁদুরের লাল খুঁজে পেয়েছেন। এখানেও তিনি উৎসবের মরমে না গিয়ে, ভুল-ভাল বিশ্লেষণের পথেই হাঁটলেন। মজার বিষয়, হুজুর কিন্তু ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্ট নাকি আছে। টেলিভিশনের টক শো করছেন। টকশোতেই স্বীকার করেছেন।
এবার এ বিষয়ে অন্য আরেকজনের কথা বলি, যাঁর কথা শুনে তো আমি তাজ্জব বনে গেছি। কোনো একটা মসজিদের জুমার নামাজে দাঁড়িয়ে বয়ান করছিলেন তিনি। তাঁর এই ভিডিওটি ফেসবুকে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। হুজুরের খেদ আবার ইলিশ মাছ নিয়ে। তাঁর শুরুটাই এ রকম, ‘পহেলা বৈশাখকে উপলক্ষ করে গতকাল যাঁরা ইলিশ মাছ খেয়েছেন, পান্তা ভাত খেয়েছেন, আমি ভয় পাচ্ছি আপনার হাশর হিন্দুর সাথে হয় কি না!’ ইলিশ-পান্তায় তিনি হিন্দুয়ানি খুঁজে পেলেন! আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না ইলিশ খেলে কী দোষ? ইলিশ তো হালাল খাবারও বটে। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে খাওয়া যাবে না কেন? আমার মাথায় আসে না। আমি একজন মুসলমানকে চিনি, যিনি ধর্মটা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন এবং এ রাজনৈতিক দিক নিয়ে কথা বলেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পান্তা-ইলিশ সম্পূর্ণ হালাল খাবার। আল্লাহ মানুষের জন্য যা হালাল করেছেন, নববর্ষে তা খাওয়া যাবে না এমন বলার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।’
ওই হুজুর আরো বললেন, ‘যে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে হলুদ লাল শাড়ি কিনে দিয়েছেন, যে বাবা তাঁর সন্তানকে পোশাক কিনে দিয়েছেন, আমি চিন্তিত আপনারা হিন্দুদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন কি না? ’ এটাও ঠিক আমার মাথায় আসছে না, এত অল্পতেই কী করে একজন মুসলমান থেকে হিন্দু হয়ে যান। আমি যতটা জানি, ইসলামে খুব সহজেই কাউকে বিধর্মী বা অন্য ধর্মের কাতারে ফেলে দেওয়া যায় না। আর হিন্দুরা তো অন্য ধর্মের কাউকে গ্রহণই করেন না।
নাম না জানা এই মাওলানা বলেন, “কোনো মুসলিম যদি রাস্তার মধ্যে পহেলা বৈশাখের বিলবোর্ড ছাপায় ‘শারদীয় পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা’, আমি তাকে নিয়ে চিন্তিত। আমি চিন্তিত আপনার হাশর হিন্দুর সাথে হয় কি না! কোনো মুসলিম ছেলে পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা জানাতে পারে না। অসম্ভব।” আমি বিনয়ের সঙ্গে বলছি, আপনি মনে হয় জানতেন না, পয়লা বৈশাখে কেউ শারদীয় বলেন না। শারদীয় বলে শরৎকালে, গ্রীষ্মকালে নয়। ইসলাম অবশ্যই ভুল-ভাল তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে কোনো সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে না। আমরা তো সবাই জানি জ্ঞানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে পর্যন্ত যেতে বলেছেন।
হুজুর আরো চিন্তিত হয়ে বললেন, যাঁরা আগের দিন পহেলা বৈশাখ পালন করে পরের দিন জুমার নামাজ আদায় করতে এসেছেন, তাঁদের হাশর কি হিন্দুদের সঙ্গে হবে!
আমি তাঁকে আবারও জিজ্ঞাসা করতে চাইব কী করে মুসলমানদের এত সহজে অন্য ধর্মের মানুষ বানিয়ে দিলেন বা ভাবছেন সে রকম হলো কি না?
ওপরে আলোচিত এই দুই আলেম-ওলামার মতো বাংলাদেশে অনেকেই আছেন যাঁরা বিভিন্ন সময়ই সাধারণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করছেন বটে। সংস্কৃতিকে ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। ধর্মের নৈতিক বিষয় নিয়ে কথা না বলে তারা শুধু আচরণকে সামনে আনছেন। অথচ নৈতিক বিষয়টাই ধর্মের জন্য বেশি জরুরি। চারদিকে এত অসৎ কার্যকলাপ, দুর্নীতি, ধর্মের নামে অধর্ম, বেইনসাফি- আমার তো মনে হয় এর বিরুদ্ধে তাঁরা কমই বলেন। অথচ তাঁরা বেশি ব্যস্ত থাকেন পান্তা-ইলিশ আর মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা নিয়ে।
একদিকে জঙ্গিবাদীদের কার্যকলাপ নিয়ে মুসলমানরা সারা বিশ্বেই যখন বিপদের মুখে আছে, সাম্রাজ্যবাদীদের নীলনকশায় পড়ে যখন মুসলমানরা বিশ্বজুড়েই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তখন সে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই বাদ দিয়ে তাঁরা ব্যস্ত আছেন নিজের সংস্কৃতিকেই নিজের প্রতিপক্ষ করার কাজে। এতে ইসলাম ধর্ম যেমন দুর্বল হবে, তেমনি নষ্ট হবে জাতীয় ঐক্য। আর এর সুযোগ নেবে জঙ্গিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। কথাগুলো ভারী হলেও এই সত্য বোঝার দিকে এ দেশের আলেম-ওলামাদের মন দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এ দেশে ইসলামের বিকাশ হয়েছে সুফিবাদী ধারায়, যারা এ দেশের সংস্কৃতি ও আচারকে ধারণ করেই নৈতিক ইসলামের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করেছে। সেটাকে উগ্রবাদের দিকে ঠেলে দেওয়া যেমন খোদ ইসলাম ধর্মের জন্য ভয়ঙ্কর তেমনি দেশের জন্যও। কারণ আমাদের সামনে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক লিবিয়াসহ অসংখ্য উদাহরণ আছে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।