অভিমত
দেশ আসলে কারা চালায়?
নিন্দুকেরা একটা কথা প্রায়ই বলে থাকে, বাংলাদেশ আসলে সব সম্ভবের দেশ। এখানে নাকি সবই সম্ভব। সরকারের চেয়ে কিছু ব্যক্তি বা কিছু গোষ্ঠীর হাতে অনেক ক্ষমতা থাকে। তারা সরকার বা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে নিজেদের মতো করে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সরকারকে কখনো কখনো এদের কাছে অসহায় মনে হয়।
সরকারের ভাবটা এমন, কী করতে পারি আর? ওরা এতটা ক্ষমতাবান। পারলে দেশটাকে অচল করে দিতে পারে ওরা। দেশের মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে দিতে পারে। তাদের অঙ্গুলি নির্দেশে সারা দেশের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দেশের এক স্থানের খাদ্যদ্রব্য অন্যস্থানে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে দাম বৃদ্ধি ঘটবে। নিম্নশ্রেণির মানুষ, যারা দিন আনে দিন খায়, তারা না খেয়ে থাকবে। দেশে হাহাকার সৃষ্টি হবে। মানুষের অফিসে যাওয়া আসায় ব্যাঘাত ঘটবে। স্কুল-কলেজে যেতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে।
সরকার সেই ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময় করবে। এ সুযোগে তারা তাদের অনেক দাবি দাওয়া আদায় করার প্রস্তাব দেবে। এক সময় আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এই কাহিনী দেখে আসছে বাংলাদেশের জনগণ। আর তাই তো নিন্দুকরা বলার সুযোগ পায়- বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ।
আর এই কাজটা করে বাংলাদেশ পরিবহন মালিক শ্রমিক সমিতি। তাদের রয়েছে লাখ লাখ সদস্য। সবচেয়ে লাভজনক সংগঠন হচ্ছে এটা। সদস্য হওয়ার জন্য কিছু করতে হয় না। খুব সামান্য ঘটনায় রাস্তায় পরিবহন আটকে যাত্রীদের নামিয়ে গাড়ির কাঁচ জানালা ভেঙে দিলেই নাম লেখানো যায়। ভয়ে মালিক সমিতি তাদের দলে টেনে নেয়। কারণ তাদের রাস্তায় গাড়ি নামাতে হবে।
আরেকটি হচ্ছে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই সরকারের শ্রমিক সংগঠন এই মালিক সমিতিকে কুক্ষিগত করে ফেলে। গজিয়ে ওঠে টেম্পো লীগ বা দল, রিকশা লীগ বা দল, ট্রাক লীগ বা দল, মিনিবাস লীগ বা দল। এই সংগঠনের প্রভাবে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায় সাধারণ মানুষের। সরকারের কিছু করার থাকে না। এদের কারণে জনগণের দুর্ভোগ হলে ধরপাকড় শুরু হয়। কিন্তু থানায় যাওয়ার আগে ওপর থেকে ফোন চলে আসে ছেড়ে দেওয়ার, নইলে দেশ অচল হয়ে যাবে। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যাবে, এ রকম ভয় দেখিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রমিকনেতা রূপী সন্ত্রাসীদের।
পাঁচদিন ধরে রাজধানীতে পরিবহন সেক্টরে যা হচ্ছে তা রীতিমতো মগের মুল্লুক। কারণ পরিবহন মালিক শ্রমিক সমিতি যা শুরু করেছে তা দেখে মনে হয় দেশটা তারাই চালাচ্ছে। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের নিজের অসহায়ত্বের কথা বলেছেন এভাবে-‘ কেউ নানা অজুহাতে যদি গাড়ি না চালায়, আমরা কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় জোর করে গাড়ি নামাতে পারব? আর গাড়ির সঙ্গে যারা জড়িত তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেক প্রভাবশালী।’
মন্ত্রী বাহাদুরের এই কথায় কিসের ইঙ্গিত করেছেন তা আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না। কারণ দেশের পরিবহন শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হচ্ছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তাঁর মালিকানাধীন রয়েছে কয়েকটি পরিবহন। তাঁর কৃতকর্ম বা ক্ষমতা দেশবাসীসহ সবাই জানে। তিনি কী পারেন না? সবই পারেন। দেশ অচল করে দেওয়া তাঁর কাছে ওয়ান-টুএর ব্যাপার। তার অঙ্গুলি নির্দেশে গাড়ি রাস্তায় যেমন নামতেও পারে আবার গাড়ি ভাঙচুর করে জানমালের ক্ষতি করে দিতে পারে।
যত কথাই বলি না কেন, দিনশেষে আমরা সাধারণ মানুষ অসহায়।
অভিজ্ঞতা থেকে দু-একটা কথা বলি, ১৬ এপ্রিল থেকে সিটি সার্ভিস বন্ধ। ভাড়া হবে লোকাল বাসের। যাত্রী যেখানে সেখানে তুলবে এটাই স্বাভাবিক।
১৬ এপ্রিল। সকালবেলা অফিসে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছি। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে তেঁতুলিয়া পরিবহনে উঠি। নামি খিলখেত। ভাড়া আগে ছিল ৩০ টাকা। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে একটা বাস পেলাম। ভাগ্য প্রসন্নই ছিল, সিট পেয়ে গেলাম। কালশী আসার পর বাস থামল, স্ট্যান্ড থেকে দু-একজন নেতা গোছের লোক এগিয়ে এলো। সাথে একঝাঁক কর্মী। ভিলেন স্টাইলে একজন চোখের সানগ্লাস খুলে ড্রাইভারকে বলল, ‘যাত্রী উঠাবি পাড়াইয়া, ভাড়া নিবি আগের মতোই। কেউ যদি চিল্লায় এখানে গাড়ি বন্ধ কইরা নামাইয়া দিবি।’ ভাড়া দিলাম আগের শথৌই ৩০ টাকা।
১৭ এপ্রিল। আবার সেই কালশী স্ট্যান্ড। যেখানে ওয়েবিলএ স্বাক্ষর করে সুপারভাইজার। লোকজনের জটলা। পোশাক-আশাক বেশ পরিপাটি এমন একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এসে যাত্রীদের বলল, ‘ভাড়া আগের মতোই দিবেন।’
একজন যাত্রী জানালার কাছে এগিয়ে বলল, ‘আপনাদের ভাড়ার চার্টটা বাসে টানাইয়া রাখেন। আমরা সেই অনুযায়ী ভাড়া দিব।’
সেই পরিপাটি ভদ্রলোক বলল, ‘ভাড়া আগেরটাই আছে। আগের ভাড়াই দিবেন। ক্যাঁচ ক্যাঁচ কইরেন না। না যাইতে চাইলে নাইমা যান। অন্য যাত্রীদের ডিস্টার্ব কইরেন না। আপনেগো মতো যাত্রীগো জন্যই এই অবস্থা।’
অফিসের সময় অনেকের নষ্ট হচ্ছে বলেই কেউ কেউ বলল, ভাই এতক্ষণ বাস থামাইয়া রাখার কী মানে? বলেন। লোকটা কোনো কথা না বলে চলে গেল। তার সঙ্গে যারা বাসের কাছে এগিয়ে এসেছিল তারা বাইরে থেকে প্রতিবাদকারী লোকটার দিকে এমন ভাব নিয়ে তাকাল যেন তাকে বাস থেকে নামিয়ে একদম খেয়েই ফেলবে।
এসব দেখে মনে হচ্ছে দেশ আসলে কারা চালাচ্ছে? দেশ কি নৌপরিবহনমন্ত্রী চালাচ্ছেন? প্রশ্নটা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কাছেই থাকল।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।