অভিমত
‘কলকাতাকে পথ দেখাল ঢাকা’
দিন কয়েক আগের কথা। টেলিভিশনের চ্যানেল ঘোরাতেই হঠাৎ চোখ আটকালো ভারতের জি বাংলায়। দিদি নাম্বার ওয়ান অনুষ্ঠানে আরো কয়েকজনের সাথে ছিলেন বাংলাদেশেরও এক প্রতিযোগী। শান্তিনিকেতনে নাচ নিয়ে পড়াশোনা করছেন মেয়েটি। তার কাছে বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের খবর নিলেন অনুষ্ঠান সঞ্চালক ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়িকা রচনা ব্যানার্জি। শুনছিলেন ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রার কথা, রমনায় ছায়ানটের আয়োজন ইত্যাদি। শুনে অনেক আক্ষেপ করে বললেন, ‘ইস আমাদের এখানে তোমাদের ওখানকার মতো যদি হতো’।
আমাদের পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের এই আক্ষেপে মুগ্ধতা যেমন ছিল তেমন একটু চাওয়াও ছিল। সে চাওয়ার এত দ্রুতই প্রাপ্তি ঘটবে তা কে বা আন্দাজ করতে পেরেছিল? রোববারের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ‘বাঙালিয়ানা ও সংহতিতে বর্ষবরণ’ শিরোনামের খবর সে প্রাপ্তিরই জানান দিল।
এই প্রথমবারের মতো বর্ণাঢ্য আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রা করে নতুন বাংলা নববর্ষ উদযাপন করল কলকাতা। আমার কথা না, খোদ আনন্দবাজারও সেই কৃতিত্ব দিতে ভুলেনি। তারা লিখেছে ‘ এ বছর শহরজুড়ে বাংলাদেশের মতো করে বহু সমারোহে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসবে মেতেছিলেন বহু বাঙালি। নববর্ষের সকালে গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর পর্যন্ত শোভাযাত্রায় ছিল পথজোড়া আল্পনা, রণ-পা, চৌ-মুখোশ, পট-সহ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির বিবিধ নিদর্শন।’ এই শোভাযাত্রার অন্যতম উদ্যোক্তা বুদ্ধদেব ঘোষ আনন্দবাজারকে জানালেন, ‘বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুপ্রেরণাতেই এই আয়োজন, যার অন্যতম বার্তাই হল সম্প্র্রীতি’। যে ছবিটি ছাপিয়েছে আনন্দবাজার প্রত্রিকা তার ক্যাপশনেও লিখেছে ‘ বাংলাদেশের মতো বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা’।
এই খবর বেশ কয়েকটি কারণে তাৎপর্যপূর্ন। বিশেষ করে আমাদের দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী যখন বারবার নানা অভিযোগ করে আসছে। তখন অন্তত এটা স্পষ্ট হয় যে, এটা ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বলে পরিচিত ভারত (সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ) থেকে আমদানি করা হয়নি। বরং এটা বাংলাদেশের সৃজনশীল আচার। ধর্মীয় নয় বরং লোকজ নানা উপাদান নিয়েই এই বর্ণাঢ্য আয়োজনের শুরু হয় আশির দশকের শেষভাগে। ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে এটি এখন পহেলা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রচারণা দিন দিন বেড়েই চলছে নানা মহল থেকে। হালে বিভিন্ন ধর্মীয় দাবি নিয়ে সোচ্চার, সরকারের কাছে যাদের দাবি বিভিন্ন সময়ই গুরুত্ব পাচ্ছে, হেফাজতের সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে নানাবিধ কারণে ইসলামবিরোধী আচার বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেই বিবৃতিতে দেখা যায়, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে একটি সাম্প্রতিক সেক্যুলার আবিষ্কার হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
এই বিবৃতির আরো অনেক দিক আছে, আমি সঙ্গত কারণে সে বিষয়ে আলোচনায় গেলাম না। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস হেফাজতের এই বিৃবৃতির ড্রাফট রচিত হয়েছে বাংলাদেশের একজন বড় তাত্ত্বিকের হাতে। জ্ঞানী লোকের জন্য ইশারাই যথেষ্ঠ। আগ্রহীরা অনলাইনে খুঁজে দেখতে পারেন।
উপরের এই অভিযোগগুলো সত্য-মিথ্যা আদতে সাধারণ মানুষের আদালতেই নির্ধারিত হবে। কেউ এর পক্ষে থাকবেন, অন্তত ফেসবুক দেখলেও এটা অনুমান করা যাবে।
আবার এমন অভিযোগের সঙ্গে একমত নন এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কম নয়। এমনকি যারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান তারাও এ ধরনের অভিযোগের বিরোধিতা করেন। ধর্মীয় পোশাক পরিহিত অনেক মানুষকেও এ শোভাযাত্রায় দেখা যায়।
ইতিহাস বলে, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়ও এ দেশের কিছু মানুষ আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগেছে। ধর্মীয় কারণে তারা মাতৃভাষাকে বাদ দেয়াকেও স্বাভাবিক মনে করেছে। অথচ খোদ ইসলাম স্বদেশ ও ধর্ম মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরত্ব দিয়েছে। সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশেও যে রাজনৈতিক ইসলামের বিকাশ হয়েছে, সেটি দেশীয় সংস্কৃতিকে আত্মীকরণ নয় বরং খারিজ করেই আগানোর চেষ্টা করছে। আর এ ঘটনায় ’৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান-ভারত বিরোধিতা ও এর পূর্ববর্তী মুসলমান-হিন্দুর ঐতিহাসিক বিরোধের ভূমিকাও আছে বটে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও জামায়েত ইসলামীসহ এ দেশের একাধিক ইসলামী দল ও সম্প্রদায় পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের ক্ষমতা আকড়ে থাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করার যে প্রহসন, তার শিকার হয়েছিল। সেই বিভ্রান্তি থেকে কখনো তারা বের হতে পারেনি। দেশীয় সংস্কৃতিকে বরাবরই হিন্দুয়ানির প্রতিশব্দ হিসেবে দেখেছে। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রার লোকজ উপাদানকেও তারা হিন্দুয়ানি বলে ব্যাখ্যা করছে।
বতর্মান সময়ে এসেও হেফাজত অভিযোগ করছে যে, দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় কখনো রাক্ষস বা দানব হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এই প্রেক্ষপট তো ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের নারকীয় গণহত্যায় সহযোগিতা করার মাধ্যমে এ দেশের একাধিক ইসলামী দল ও সম্প্রদায়ই তৈরি করেছে। এখন অব্দি তারা নিজেরাও সে ডিলেমা থেকে বের হতে পারেনি, বরঞ্চ হালের হেফাজত থেকে শুরু করে অন্যদেরও আক্রান্ত করছে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা বারবার দেখছি ইসলাম ধর্ম আর দেশীয় সংস্কৃতি পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে থেকেছে। আর এ ক্ষেত্রে এ দেশের কিছু অতি ধর্মনিরপেক্ষবাদীরাও মাঝেমধ্যে বিভেদের দেয়ালকে প্রশস্ত করেছে মুসলিম সংস্কৃতিকে অবহেলা করার মধ্য দিয়ে। পহেলা বৈশাখের মতো বিভিন্ন বাঙালিয়ানা উৎসবে প্রাচীন ঐতিহ্যকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখলেও ইসলামকে পশ্চাৎপদ বলে দূরে ঠেলার চেষ্টা করেছে।
ফলে অসাম্প্রদায়িক এই উৎসবকে অপেক্ষাকৃত গোঁড়া মুসলমানরা প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে একে বিজাতীয় বলে প্রপাগান্ডা চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে। তা ছড়া কখনো এখানেও তারা ভারতকে হিন্দুত্বের প্রতিনিধি হিসেবে দেখছে।
কিন্তু ব্যাপার হলো বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযত্রায় যদি হিন্দুয়ানি কোনো উপাদান বা চিহ্ন থাকেও সেটা ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ থেকে উৎসারিত নয়। এটা স্থানীয়। বাংলাদেশ একটা বহু ভাষার, বহু ধর্মের রাষ্ট্র। ফলে এখানকার লোকজ ও দেশীয় উৎসবে বিভিন্ন ধর্মের উপাদান বা চিহ্ন আসতেই পারে। কারণ ধর্ম তো জীবনের বাইরে কিছু না। হাতি ঘোড়া কিংবা বাঘ সিংহ তো বাস্তব। তার তো কোনো হিন্দু-মুসলিম চরিত্র নেই। তো তাকে লোকজ আচার- উৎসবে নিয়ে আসা মানে তো ধর্ম পালন নয়। কারণ পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় কেউ ধর্ম পালন করতে আসে না, আসে আনন্দ করতে, নতুনকে বরণ করতে।
বাংলাদেশের বাঙালিরা, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান অথবা কারো মতে মুসলামান বাঙালিরা ( অন্যান্য জাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায় সহযোগে) ১৯৭১ সালে অনেক রক্তের বিনিময়ে একটা স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিলেও তার শক্তিটা কমই উপলব্ধি করতে পেরেছে। বরং তাকে পায়ে ঠেলে এই দেশের জাতীয় ঐক্যকে বরাবরই দ্বিখণ্ডিত বা বহু-খণ্ডিত করার চেষ্টা করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের একটা আফসোস আছে, তারা ভারতীয় রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে আটকে গিয়ে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি, পারবেও না। তাই তাদের পক্ষে বিশ্বের বাঙালিকে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। সেটা বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব। পহেলা বৈশাখের মতো অনুষ্ঠানই সে চেতনাকে শাণিত করে। আর বহু ভাষা ও সংস্কৃতির চাপে পিষ্ট পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যখন চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়, তখন তারা বাংলাদেশের দিকেই চেয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশের মতোই তারা মঙ্গল শোভাযাত্রা করে।
তাই বলছি, বাঙালিত্বের শক্তিটা আমাদের উপলব্ধি করতে করতে হবে। যেটা কলকাতা ঢাকা থেকে শিখল বা শিখছে, অথচ আমরা নিজেরাই কি না সেটা ধরতে পারছি না।
তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে ধর্ম আর সংস্কৃতি বিপরীতে হাঁটবে নাকি গা-জড়াজড়ি করে থাকবে। কথায় কথায় সবকিছুকে ধর্মীয়ভাবে ব্যাখ্যা করার যে অসুখে বাঙালি মুসলমানরা আক্রান্ত হচ্ছে, তার আশু রোগমুক্তি না হলে যে ঘোর অমঙ্গল! কারণ রোগটা বড় ছোঁয়াচে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।