শিশু নির্যাতন
প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা
দেশে শিশু নির্যাতন বিষয়ক যেসব তথ্য ও সার্বিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়ে থাকে। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা এই সংগঠনগুলো তাদের সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে ৬টি বা ১২টি পত্রিকার ‘কনটেন্ট অ্যানালাইসিস’ বা আধার বিশ্লেষণ করে এই কলেবরের গবেষণাগুলো করে থাকেন। এতে দেশের সার্বিক শিশু নির্যাতন পরিস্থিতির একটা ধারণা পাওয়া যায় সত্য কিন্তু এই পরিসংখ্যানের মাধ্যমে শিশু নির্যাতন পরিস্থিতির ব্যাপকতার যথাযথ চিত্র পাওয়া যায় না। অর্থ্যাৎ প্রতিদিনের পত্রিকা যেমন সার্বিক বাংলাদেশের ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ বা প্রতিচ্ছবি নয় একইভাবে এই ধরনের কনটেন্ট অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে পাওয়া শিশু নির্যাতনের চিত্রও বাংলাদেশের সার্বিক শিশু নির্যাতনের চিত্র নয়। তা ছাড়া সংবাদপত্র বা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমগুলোর সংবাদ উপস্থাপনায় বিভিন্ন ধরনের ‘বায়াসনেস’ বা বাধাও আছে। এই বাধাগুলোর কারণ সংবাদপত্রের মালিকানার ধরন, বিজ্ঞাপনদাতা কে বা কারা, সম্পাদকের রাজনৈতিক মতাদর্শগত বাধাসহ বিভিন্ন ধরনের অনুঘটক বিদ্যমান।
এসব কারণে সংবাদপত্র থেকে সংবাদপত্রের সংবাদ উপস্থাপন যেমন ভিন্ন হয় একইভাবে তাদের মনোযোগও ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর হয়। যেমন কোনো সংবাদমাধ্যম ব্যবসায়িক বা অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যেও আবার কোনোটা বা রাজনৈতিক। কোনোটার টার্গেট অডিয়েন্স মধ্যবিত্ত আবার কোনোটার উচ্চবিত্ত। তাই কোনটা সংবাদ আর কোনটা সংবাদ নয় সেটা মহাবিতর্কের বিষয়। কাজেই শুধু সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত শিশু নির্যাতনের সংবাদের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের শিশু নির্যাতনের সার্বিক চিত্র বুঝতে পারা বেশ মুশকিল।
তবুও এসব গবেষণা দেশে শিশু নির্যাতনের সাম্প্রতিক প্রবণতা, ধরণ, মাত্রা বিবেচনা করার ক্ষেত্রে সহায়ক। আর সেই চিত্রই বাংলাদেশের জন্য রীতিমতো ভয়াবহ। এ বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি সংবাদ বিবরণীতে শিশু অধিকার ফোরামের গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়। সেই গবেষণায় জানা যায়, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৫৮৯ জন শিশু সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৪৪১ জন শিশুর অপমৃত্যু ঘটে। যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ৬৮৬ জন শিশু। অন্যদিকে ২০১৫ সালে শিশুকেন্দ্রিক এই সহিংসতা ও নির্যাতনের মোট ঘটনা ছিল পাঁচ হাজার ২১২টি।
এই তথ্যে জানানো হয়েছে, সংখ্যার দিক থেকে আগের বছরের তুলনায় ২০১৬ সালে শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা কিছুটা কমলেও বদলেছে সহিংসতার ধরন; বেড়েছে নির্যাতনের ভয়াবহতা। পাশাপাশি, আশঙ্কাজনকভাবে মা-বাবার হাতে শিশুহত্যা এবং শিক্ষকদের হাতে নির্যাতনের হারও বেড়েছে।
তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ৬৪জন শিশু মা-বাবার হাতে খুন হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি। ২০১৫ সালে এর সংখ্যা ছিল ৪০। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০১৬ সালে ২৬৩ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়।
তবে শিশুহত্যা, আত্মহত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ২০১৬ সালে আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। গত বছর খুন হয় ২৬৫ জন শিশু। আর এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ২৯২। ২০১৬ সালে ৪৪৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়; আর আগের বছর ৫২১ জন। শিশু অপহরণের ঘটনাও কমেছে। তবে বেড়েছে নবজাতক চুরির ঘটনা।
যদিও বাংলাদেশে শিশু নির্যাতন রোধকল্পে ২০০০ সালেই আইন প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু সংশোধন করে এটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ নামে প্রচলিত। আইন অনুযায়ী অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ড। এ ছাড়া অপরাধের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদি কারাদণ্ড এবং সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৭৫৪টি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ১৮৪টির।
একই অনুপাতে মামলার পরে বিচার পাওয়ার পরিমাণও কমে যায়। অর্থ্যাৎ বাস্তব নির্যাতনের চিত্র থেকে যে অংশত নির্যাতনের খবরগুলো পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমে আসে সেগুলোর ভেতর খুব কম সংখ্যক ঘটনার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং মামলার পর বিচার পাওয়া ঘটনাগুলো আরো কমে যায়। সেই সঙ্গে আছে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘমেয়াদি পথপরিক্রমা। অভিযুক্তের পেশিশক্তিসহ প্রভাববিস্তারকারী ক্ষমতার প্রয়োগের ফলেও তৈরি হয় বিচারহীনতা।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক করণেই রাতারাতি এর পরিবর্তন করে ফেলা সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেরই একার পক্ষে করে ফেলা সম্ভব নয়। সরকারের সার্বিক সহযোগিতা নিয়েই শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতার মাত্রা বৃদ্ধি করতে হবে। যদিও পরিবার ও বিদ্যালয় শিশু নির্যাতনের ঘটনার ক্ষেত্রে অন্যতম উৎস তবুও পরিবার থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, উচ্চ বিদ্যালয় এমনকি কলেজ বা মহাবিদ্যালয়গুলোকে এই সচেতনতা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। যেন স্কুলগুলো তাদের আওতাধীন এলাকার গ্রামে গ্রামে বা মহল্লায় মহল্লায় গিয়ে শিশু নির্যাতন বিরোধী কর্মসূচি নিতে পারে। সেই সঙ্গে প্রতিটি পরিবারকে যুক্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ বা ওয়ার্ড কাউন্সিল বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সাধারণত কর্মজীবী শিশুরা অধিক নির্যাতনের শিকার হয় সেক্ষেত্রে বাজারে বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সচেতন করা কর্মসূচিগুলো আবশ্যক লক্ষ্য হওয়া উচিত।
অন্যদিকে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক নিবন্ধ-প্রবন্ধ-সংবাদ এবং অনুষ্ঠান প্রকাশ ও প্রচার করা যেতে পারে।
যেকোনো সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, এইচআইভি এইডস ও আর্সেনিক রোগ থেকে বাঁচতে সচেতনতা কার্যক্রম, ছেলে ও মেয়ে শিশুর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে কার্টুন সিরিজ মীনা বা স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে সবুজ ছাতাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এর অনন্য উদাহরণ।
শিশু নির্যাতন একটি সামাজিক রোগ। এই রোগ থেকে পরিত্রাণ ব্যতিত একটি উচ্চ মানবিক সমাজ তৈরির অন্য কোনো বিকল্প নেই। শিশু নির্যাতন বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮৩ সাল থেকে মাসব্যাপী পরিচালিত হয় বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি। বছরের এপ্রিল মাসকে তারা ‘জাতীয় শিশু নির্যাতন নিরোধ মাস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
শিশু নির্যাতন রোধে আমাদের আইন আছে, কমবেশি আইনের প্রয়োগও আছে। বিভিন্ন সংগঠন, বেসরকারি সংস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠান শিশু নির্যাতন রোধে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়তই নিচ্ছে কিন্তু শিশু নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ সংখ্যক অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে শাস্তি নিশ্চিত করা। আর তা সম্ভব না হলে পত্রিকার পাতায় ভয়াবহতম সংবাদ পড়ার অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না!
লেখক : শিশু অধিকারকর্মী