জঙ্গি সংকট
অপারেশন টোয়াইলাইট নিয়ে কিছু কথা
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও দুর্ধর্ষ জঙ্গিদল ইসলামী স্টেট বা আইএস এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তারা ২০১৫ সাল থেকেই বাংলাদেশে ‘ওয়েভ অব কিলিং’ বা ‘হত্যাকাণ্ডের লহরি’ শুরু করে দিয়েছে। খবরটি অনলাইনে এমনভাবেই উপস্থাপনা করেছে গত ২৬ মার্চ-২০১৭, আমাদের স্বাধীনতার দিবসের তারিখে ভারতের একটি টেলিভিশন চ্যানেল, নিউ দিল্লি টেলিভিশন লিমিটেড বা এনডিটিভি। এসব ‘হত্যাকাণ্ডের লহরি’তে সবচেয়ে বড় আক্রমণ ছিল দুটি। প্রথমটি ছিল ১ জুলাই-২০১৬ তারিখে গুলশানের হলি আর্টিজানে। আর দ্বিতীয়টি হলো বর্তমানে চলমান গত ২৩ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সিলেটের শিববাড়ি এলাকায় অবস্থিত পাঁচতলাবিশিষ্ট ভবন ‘আতিয়া মহলে’।
সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল আতিয়া মহলে অপারেশন ‘টোয়াইলাইট’ শুরু করেছে গত ২৫ মার্চ ২০১৭ তারিখ সকাল ৯টার দিকে। এরপর ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এলাকার বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে, স্কুল-কলেজ বন্ধসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
দুটি বিষয় এখানে লক্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত, আতিয়া মহলে সোয়াটসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে সেনা কমান্ডো দল নিয়োজিত করা; দ্বিতীয়ত, অপারেশন টোয়াইলাইট শেষ করতে এত দেরি হচ্ছে কেন? আমার কাছে দুটি প্রশ্নেরই একটি উত্তর রয়েছে, তা হলো ‘জননিরাপত্তা’।
আমি আমার আরেকটি লেখায় সতর্ক করে বলেছিলাম, জঙ্গিরা যদি আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকেও বেশি প্রশিক্ষিত হয়, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বিপজ্জনক। তবে কি আতিয়া মহলে অবস্থানরত জঙ্গিরা তাই জানান দিচ্ছে? আর এটা হলে সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল মোতায়েন ছিল দ্বিতীয় কারণ।
দ্বিতীয় প্রশ্নে, অর্থাৎ অপারেশন শেষ করতে এত দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে বলা যায় জঙ্গিদের ‘রণকৌশলগত’ দক্ষতার কথা। তারা আতিয়া মহলে বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় ইচ্ছে করেই একবারে নিচতলায় ভাড়া নিয়েছে। হতে পারে জঙ্গিরা অনেক চিন্তা করে, অনেক দিনক্ষণ অপেক্ষা করে এই বাসা ভাড়া নিয়েছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে আমি আমার সব লেখাই সতর্ক করেছিলাম। মনে হয়, থানায় লোক কম হওয়ায় কিংবা বাড়িওয়ালাদের গাফিলতির কারণে এমনটি হচ্ছে।
জঙ্গিরা আগে থেকেই তাদের রণকৌশল ঠিক করে রেখেছিল এই বলে যে যদি আক্রান্ত হয়, তবে ওই ভবনের বাসিন্দাদের তারা জিম্মি করে ফেলবে। তারা তা-ই মনে করেছিল। কিন্তু সেনা কমান্ডোরা ‘ভার্টিক্যাল ল্যান্ডিং’ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। তারা অন্য ভবন থেকে মইয়ের মাধ্যমে আতিয়া মহলের ছাদে প্রবেশ করে। তারপর একে একে প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে সব বাসিন্দাকে উদ্ধার করেছিল। একেবারে নিচের ফ্ল্যাটে, অর্থাৎ জঙ্গি অবস্থানের ওপরের ফ্ল্যাটে গ্রিল কেটে বাসিন্দাদের উদ্ধার করেছিল।
সেনা কমান্ডোরা দুটি পর্যায়ে এই অপারেশন ‘টোয়াইলাইট’ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেছিল। পর্যায় ১ : বেসমারিক জনগণকে উদ্ধার করা এবং পর্যায় ২ : মূল অপারেশন। এখন পর্যন্ত পর্যায় ১ সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। আর পর্যায় ২ এখনো চলছে।
পর্যায় ২ শেষ করতে এত দেরি হওয়ার জন্য কী কারণ রয়েছে? এগুলো হলো (১) প্রায় পুরো বিল্ডিংয়ে জঙ্গিরা আইইডি লাগিয়ে রেখেছে। যখনই কেউ তাদের আক্রমণ করতে আসবে, তখনই এগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। তাতে আক্রমণকারীরা অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। (২) কমান্ডোরা বিস্ফোরক অথবা রকেট লাঞ্চার ফায়ার করে নিচতলা উড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু এতে পুরো বিল্ডিংটিই ভেঙে যেতে পারে। কমান্ডো দল রকেট লাঞ্চার ফায়ার করে একটি ছিদ্র করার চেষ্টাও করেছে। এসব ছিদ্র বা পথ করা হয় সংঘবদ্ধ ফিজিক্যাল আক্রমণের জন্য। কিন্তু মনে হচ্ছে, একটি রকেট লাঞ্চার ফায়ার করে ততটা লাভ হয়নি। তবে এই ছিদ্র পথ দিয়ে কমান্ডোরা টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছিল। ফলে জঙ্গিরা টিকতে না পেরে দখলকৃত ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে ওপরে উঠেছিল। আর তখনই বাইরে থেকে ফায়ার করে দুই জঙ্গিকে মেরে ফেলার সুযোগ হয়েছিল।
(৩) যেহেতু পুরো ভবনটিই এখন জঙ্গিদের দখলে, সেহেতু কমান্ডোদের এখন তিনটি পথই খোলা আছে। সেগুলো হলো (ক) পুরো ভবনটিকে রকেট লাঞ্চার, গ্রেনেড ও মেশিনগান দিয়ে যুগপৎ আক্রমণ করা। এতে ভবনটির ব্যাপক ক্ষতি হবে। (খ) ‘ফ্ল্যাট টু ফ্ল্যাট’ ক্লিয়ার রণকৌশল অবলম্বন করা। এতে প্রতিটি ফ্ল্যাটকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হয় এবং প্রতিটি ফ্ল্যাটে অবস্থানরত জঙ্গিদের নিষ্ক্রিয় করতে হবে। এতে অনেক সময় অনেক লাগবে। তারপর প্রতিটি ফ্ল্যাট ও সিঁড়ি এলাকা আইইডিমুক্ত করতে হবে। প্রতিটি ফ্ল্যাট কিংবা রুম ফিজিক্যালি অকুপাই করার আগপর্যন্ত এই অপারেশন শেষ বলে গণ্য হবে না। (গ) ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার সময় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ভারতের এনএসজি আকাশপথে হেলিকপ্টার র্যাপলিংয়ের মাধ্যমে হোটেলের ছাদে অবতরণ করেছিল।
গত ২৬ মার্চ ২০১৭ তারিখ শনিবার সন্ধ্যায় জঙ্গিরা দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তার কারণ ছিল দুটি—(১) মূল অপারেশন স্থান আতিয়া মহল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়া, যাতে করে জঙ্গিরা তাদের লোকদের আতিয়া মহল নিরাপদে থেকে সরিয়ে নিতে পারে, যা তারা শেষ পর্যন্ত পারেনি। (২) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ জনগণকে ব্যাপকভাবে আহত ও নিহত করা। তারা এটা সহজেই করতে পেরেছে। জঙ্গি বাদে এ ঘটনায় নিহত হয়েছে ছয়জন। আহত হয়েছেন ৪৪ জন।
আমি আশা করি, শিগগিরই এই অপরেশন শেষ হবে। এখন কমান্ডোদের অপারেশন দীর্ঘায়িত করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। তারা এখন দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এগুলো হলো : (১) ‘অবরোধ রণকৌশল’ বা সিজ টেকনিক অবলম্বন, যাতে জঙ্গিরা খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে আত্মসমর্পণ করে; (২) কমান্ডোদের নতুন বা ফ্রেশ ট্রুপ মোতায়েন করতে হবে, যাকে বলা হয় ‘প্যাসেইজ ইন লাইন’ রণকৌশল।
তবে এই অপারেশন শেষ মানে চূড়ান্ত শেষ নয়। বাংলাদেশ আরো এমন অবস্থার সম্মুখীন হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ইরাকে আইএস এখন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে।
আইএস জঙ্গিরা আরো ব্যাপকভাবে সাড়া দুনিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের উচিত নতুন করে এমন অবস্থার মোকাবিলার চিন্তা করা। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : মেজর, পিএসসিজি (অব.), আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কর্মরত।