ভারত
বিজেপির রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প
বিজেপি উত্তর প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের যে ইস্তেহার প্রকাশ করেছিল, তাতে ফলাও করে গরু পাচার এবং অবৈধ কসাইখানা বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। গত সরকারের আমলে উত্তরপ্রদেশে গরু পাচার এবং অবৈধ কসাইখানার রমরমা বেড়েছিল বলে বিজেপির অভিযোগ। এখন বিজেপির রাজত্বে সেই পরিস্থিতি বদলে দিতে তৎপর মূখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বিতর্কিত হিন্দু সাধু যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বের ওপর স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে পূর্ণ আস্থা আছে এবং উত্তর প্রদেশের পরিবর্তনের জন্য তিনি যে আদিত্যনাথের ওপরই ভরসা রাখছেন -সে কথা যেমন কারো বুঝতে অসুবিধা থাকার কথা নয়, তেমনি মোদিও প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন এমন আস্থার কথা।
২০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যে কসাইখানা বন্ধের হুকুম জারি, গরু পাচার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এমন কার্যক্রম যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বড় নমুনা তা আর কারো বুঝতে বাকি নেই। এমনকি কসাইখানা বন্ধের ফরমান জারির আগ মুহূর্তেই রাজ্যের হাথরস জেলায় তিনটি মাংসের দোকান দুষ্কৃতকারীরা পুড়িয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই মাংসের দোকানে আগুন দেওয়া এবং কসাইখানা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা রাজ্যে সামাজিক অশান্তি সৃষ্টি করছে। বৈধ মাংস ব্যবসায়ীরা এই নির্দেশ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, কসাইখানা বন্ধ করা হলে কর্মসংস্থানও কমে যাবে। কমবে রাজ্যের রাজস্ব আয়। সামাজিক অশান্তি দেখা দেবে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অবৈধভাবে ও বিনা লাইসেন্সে যাঁরা ব্যবসা চালাচ্ছে, কেবল তাঁদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু পুলিশ এই দাবি করলেও বিরোধীরা মনে করছেন, স্বঘোষিত গোরক্ষকরা অতি উৎসাহে সব মাংসের দোকান বন্ধে নেমে পড়েছেন। এলাহাবাদে যে কয়টি কসাইখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বেআইনিভাবে চলছিল বলে পুলিশের দাবি। উত্তর প্রদেশে মূলত গরুর মাংস নিষিদ্ধ। বৈধভাবে জবাই হয় শুধু মহিষ, ছাগল ও ভেড়া। রপ্তানির মাংসও মহিষের। কয়েক লাখ মানুষ এই কারবারের সঙ্গে যুক্ত। তাহলে যোগীর কসাইখানা বন্ধের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া সবার মনে একটি প্রশ্ন রয়েছে যে, যেখানে ২০ শতাংশ জনগণ মুসলিম, সেখানে গরুর মাংস নিষিদ্ধই বা কেন হবে?
যোগীর এমন কার্যক্রমের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে পরিষ্কার আমরা বুঝতে পারছি। কারণ, প্রথমত এটি বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারের অংশ, আর দ্বিতীয়ত, যোগীর শপথ অনুষ্ঠানের পর এক টুইট বার্তায় ঘোষণা করেন, মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের নেতৃত্বেই ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশ একদিন ‘উত্তম প্রদেশ’ হয়ে উঠবে। হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’ বলে পরিচিত আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করার পর থেকেই যে বিতর্ক শুরু হয়েছে এবং বিরোধীরা বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের অভিযোগ আনছে, সম্ভবত তা থেকে দৃষ্টি সরাতেই প্রধানমন্ত্রী মোদি বারবার রাজ্যের উন্নয়নের কথা উল্লেখ করছেন। একের পর এক টুইট করে তিনি ঘোষণা করছেন, ‘আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো উন্নয়ন। উত্তর প্রদেশের উন্নয়ন হলে তবেই গোটা ভারতের উন্নয়ন হবে।’ তার এমন ঘোষণা থেকেই পরিষ্কার ধারণা করা যায় যে, মোদির পূর্ণ সমর্থন নিয়েই যোগী তাঁর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই উত্তর প্রদেশের তরুণ সমাজের অগ্রগতি এবং তাদের জন্য কর্মসংস্থান বা অন্যান্য সুযোগ তৈরিতেও রাজ্যের নতুন সরকার কাজ করবে বলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো বৈধ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি মানবাধিকারের লঙ্ঘনের শামিল। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বায়নের যুগে এমন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক যাত্রা কোনোভাবেই বিশ্ব সভ্যতাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না।
কিন্তু তার পরও ভারতের বেশির ভাগ বিরোধী দল ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে উত্তর প্রদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে হিন্দু-ভোট সুসংহত করতেই খুব সুপরিকল্পিতভাবে যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে আনা হয়েছে। বস্তুত ভারতের সংখ্যালঘু বা মুসলিম ভোটের পরোয়া না করেও যে নির্বাচনে জেতা যায়- এবং বিপুল ব্যবধানে জেতা যায়, উত্তর প্রদেশের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে বিজেপি সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে।
ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই বলছেন, দু’বছর বাদের সাধারণ নির্বাচনে এই হিন্দু ভোটের ‘কনসলিডেশন’ বা সুসংহত করার প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতেই আদিত্যনাথকে উত্তর প্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতের জন্মের পর থেকে (১৯৮৫ পর্যন্ত) পুরো নেহেরু পরিবারের কাল পর্বে ভারতের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে উত্তরপ্রদেশ থেকেই। বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গোধন ট্রেনে আগুন ও ব্যাপক দাঙ্গার ঘটনাপর্ব সামগ্রিকভাবে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থান ঘটিয়েছে। আর সেসবের বেশির ভাগ এই উত্তরপ্রদেশই। সেই উত্তরপ্রদেশে মোট ৪০৩ আসনের বিধানসভা নির্বাচনে এবারই প্রথম বিজেপি ৩২৬ আসনে জয়লাভ করেছে। এর আগে গত ২০১৪ সালে মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য বিজেপি প্রথম মোট ৮০ আসনের মধ্যে ৭৩ আসনের বিজয় লাভ করেছিল। সেটাই উত্তরপ্রদেশে বিজেপির পা রাখার শুরু বলা যায়। পরে দিল্লি রাজ্য সরকারের নির্বাচনে এবং বিহারের রাজ্য নির্বাচনে বিজেপির খুব খারাপ হার হওয়াতে এবারের নির্বাচনে বিজেপি আবার উত্তরপ্রদেশে আগের মতো বিরাট ব্যবধানে জিতবেই এটা কোনো পক্ষই নিশ্চিত ধরেনি। এ ছাড়া চার মাস আগে মোদি ভারতের ছাপা নোটের ৮৫ শতাংশ মূল্য ধারণ করে এমন ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করে দিয়েছেন। তবে কালো টাকা উদ্ধারের কোনো সুফল মোদি দেখাতে পারেননি। আবার নোট বাতিলের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরো কষ্টের হয়ে পড়েছিল। এর চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার হলো, সেই থেকে ভারতের অর্থনীতি প্রচণ্ড খারাপ অবস্থায় পড়েছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞসহ সব পক্ষই আশঙ্কা করছিল, এই নির্বাচনে ভোটে সেটা বড় ছাপ ফেলতে পারে এবং মোদি একটা বড় ধাক্কা খেতে পারেন, যা ২০১৯ সালের মোদিও দ্বিতীয় নির্বাচনী ফলাফলকেও প্রভাবিত করবে। ভারতের রাজনীতির বিচারে নোট বাতিল কেন্দ্রের রাজনীতির ইস্যু; স্থানীয় নয়। তবে এক কথায় বললে, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে ভোটদাতারা ভোট দিয়েছে কেন্দ্রীয় ‘নোট বাতিল ও এর প্রভাবকে’ উপেক্ষা করে বরং স্থানীয় নানা ইস্যুতে। এসব আশঙ্কার পটভূমিতে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির পালটা বিপুল জয়লাভ ভিন্ন ইঙ্গিত বহন করে।
উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বিপুল বিজয় সাময়িক হতাশ মোদিকে আরো আস্থাবান করে তুলেছে। এই বিজয়কে কেন্দ্র করে মোদি ও বিজেপি আগামী ২০১৯ সালের কেন্দ্রে নির্বাচনে জয় লাভের ছক সাজানো শুরু করেছে। কারণ বিজেপির মূল্যায়ন হলো হিন্দুত্ববাদকে মুখ্য করে পরিচালিত রাজনীতি হলো, ভোটের বাক্স ভরানোর উপযুক্ত এবং বিজেপির জন্য পারফেক্ট রাজনীতি। এবারে বিজেপি যে কৌশলের ওপর এককভাবে ৭৮ ভাগ আসন জিতেছে তা হলো, ২০ শতাংশ মুসলমান ভোটারের পরোয়া না করে এর বিপরীতে ব্রাহ্মণ থেকে যাদব ও আরো নিচু জাত এভাবে সব হিন্দু জনসংখ্যার নানা অংশকে যত দূর সম্ভব ভোটের একই বাক্সে ভরে আনা। ভোটের রাজনীতিতে যাই ঘটে থাকুক না কেন, দেশ ও রাজ্য চালাতে সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রের শক্তিকে মজবুত করা যায়। বিশেষ করে বিশ্ব মানবতার নিদর্শন গড়তে সামগ্রিক ভারতীয় রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে রেখে এগিয়ে যাওয়াই মোদি ও যোগীর একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।