অভিমত
গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না
বাংলাদেশ তথা পুরো উপমহাদেশে রেল লাইন বসিয়েছিল ব্রিটিশরা। ইতিহাসের অলঙ্ঘনীয় ধারাবাহিকতায় সুবিশাল বাংলার মাঠ প্রান্তরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা রেলপথের ওপর দিয়ে একসময় ব্রিটিশদের প্রেতাত্না চলে যায়। তারপর ঘটনাচক্রে পাকিস্তান আসে আরো পরে স্বাধীন বাংলা। কিন্তু পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে রেলের সম্প্রসারণ ঘটেনি বরং সংকোচন ঘটেছে। বিভিন্ন রুটে রেল চলাচল বন্ধ হয়েছে এবং শত শত কিলোমিটার রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে।
১৮৫৬ সালে এ দেশে রেলের যাত্রা শুরু হয়। এর অর্ধশতাধিক বছর পরে চীনে রেল চালু হয়। চীন আজ বিমান গতির ট্রেন আবিষ্কার করেছে।ঘণ্টায় ৫০০ কি.মি বেগে চলছে সে ট্রেন।জাপানের বুলেট ট্রেনও ঘণ্টায় ২৮০ কিমি বেগে চলছে।আর বাংলাদেশে ট্রেনের গতি কমে গিয়ে ঘণ্টায় ১০ কিমি এসে দাঁড়িয়েছে।ইতিহাস সাক্ষী, আজ থেকে ৫০ বছর আগেও এ দেশে ৬০কিমি/ঘণ্টা বেগে ট্রেন চলত।
এ সক্যাপ ও ইউএনডিপির গবেষণা বলছে, টন/কিমি মাল পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কপথে যেখানে লাগে ২১৭ টাকা সেখানে রেলপথে মাত্র ৮৫ টাকা এবং নৌপথে মাত্র ২৫ টাকা। এ কারণেই সারা বিশ্বে যখন রেলের জয়জয়কার চলছে তখন আমাদের রেলওয়েকে লাইফ সাপোর্টে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। নিরাপদ ও স্বস্তির বাহন হিসেবে রেলের যে সুনাম আছে তা এ দেশে মার খেয়েছে।
পত্রিকা মারফত জানা গেছে, গত ছয় বছরে সারা দেশে প্রায় দুই হাজার ২০০ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে।২০০৯ সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছরে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটেছে এক হাজার ৯৩টি।এসব দুর্ঘটনায় ১৫২ জন নিহত ও ৩৮৬ জন গুরুতর আহত হয়।এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৬ কোটি ৫৫ লক্ষাধিক টাকা। শুধু গত বছর জুন পরবর্তী এক বছরে দেশে অন্তত ২৭১টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে।(বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৯ আগস্ট)
রেল দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ত্রুটিযুক্ত রেললাইন ও সিগন্যাল ব্যবস্থা, অদক্ষ চালক, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন এবং লক্কর ঝক্কর মার্কা বগি জোড়াতালি দিয়ে চালানোই এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। এ বিষয়ে জানতে হলে শুধু পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের সীমাবদ্ধতাগুলো আমলে নেওয়াই যথেষ্ঠ।
দীর্ঘদিন ধরেই চালক ও ইঞ্জিন সংকটে ধুঁকছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট ডিভিশন। এ বিভাগের ছয়টি সেকশনে মোট ৬২টি ট্রেন চালাবার কথা থাকলেও ইঞ্জিন ও চালক সংকটের কারণে ২০টি ট্রেন বন্ধ রয়েছে। বাকি ৪২ ট্রেন চলছে জোড়াতালি দিয়ে। বিভিন্ন ধরনের ৪২টি ট্রেন চালাতে অন্তত ৩২টি ইঞ্জিনের প্রয়োজন হলেও ১৮টি ইঞ্জিন দিয়েই ট্রেন পরিচালনা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে একটি বাদে বাকি ১৭টি ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। এ ছাড়া ট্রেন ক্রুর মঞ্জুরিকৃত ২৫৪টি পদের মধ্যে ১২৩টি পদই শূন্য। সাব ক্রু(সাব-লোকো মাস্টার)পদের ৪২টির মধ্যে ২৫টি শূন্য।আর সহকারী ক্রু পদের(সহকারী লোকোমাস্টার)৪০টি পদ শূন্য।
রেলওয়ের এমন লেফাফাদুরস্থ অবস্থায় অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছে আমদানি নীতি। দীর্ঘদিন থেকেই ইঞ্জিন ও কোচ আমদানি করে আসছে রেলওয়ে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকা ও ইন্ডিয়ার রাইটস লিমিটেডের কাছ থেকে মোট ২৭০টি কোচ আমদানি করেছে। প্রতিটি ব্রডগেজ কোচে খরচ পড়েছে পাঁচ কোটি টাকা এবং মিটার গেজ কোচে তিন কোটি টাকা। এই কোচগুলো বিভিন্ন রুটে বেশ কটি ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মাসখানেক যেতে না যেতেই পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে "ইন্ডিয়া থেকে আনা কোচ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
ইন্ডিয়া থেকে পাঁচ কোটি টাকায়(প্রতিটি কোচ) কেনা কোচগুলো বাংলাদেশে তিন কোটি টাকায় তৈরি করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে বিশেষজ্ঞরা। ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কোচগুলোর ক্ষেত্রেও একই সত্য বহাল থাকবে।
তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, নিজ দেশে তৈরি না করে আমদানি করতে হচ্ছে কেন!সম্ভবত সঙ্গোপিত সত্যটি এই যে আমদানিতে যত সহজে পকেট ভারি করা যায় উৎপাদনে ততটা নয়।
ইন্ডিয়া থেকে আমদানি করা কোচগুলো তৈরি হয়েছে পাঞ্জাবের কাবুরথালা রেল কারখানায়। ১৯৮৭ সালে ১ হাজার ২০০ একর জমির ওপর এই কারখানাটি স্থাপন করে ভারত সরকার যা প্রতিবছর এক হাজার ৫০০ কোচ উৎপাদন করে। ওই কোচগুলো ঘন্টায় ২০০ কি.মি বেগে ছুটতে পারে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে কোচ রপ্তানি করে ভারত সরকার।
ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকা কোম্পানিটির ইতিহাসও বেশিদিনের নয়। মজার বিষয়, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার এই কোম্পানিগুলো শুধু কেবিন তৈরি করে, স্টিল ফেব্রিকেশন করে, ডেকোরেশন করে, কিন্তু ক্যারেজ বানায় না। তারা জার্মানি বা জাপান থেকে ক্যারেজ আমদানি করে তার ওপর শুধু কেবিনটি বসিয়ে দেয়।
কিন্তু বাংলাদেশেই একটি কারখানা আছে যেখানে নিজস্ব প্রযুক্তিতে বাংলা ক্যারেজ তৈরি হয়।
সৈয়দপুর রেলখানাটি ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আসাম বেঙ্গল রেলপথ ঘিরে ব্রিটিশ রাজ এই কারখানা স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠাকালীন শত শত মেশিনের শব্দ ও হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারীর পদচারণায় মুখর ছিল কারখানাটি। ওই কারখানাটিতে মঞ্জুর করা পদ ছিল চার হাজার। স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকার ২০০৩ সালে ওই সংখ্যা কমিয়ে এক হাজার ৬২১ জনে দাঁড় করায়।
দূর্ভাগ্যজনক সত্য হলো কারখানাটিকে আজ ধ্বংসোন্মুখ পরিস্থিতিতে দাঁড় করানো হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া আর ইন্ডিয়ার কারখানাগুলোর পিতামহের বয়সী একটি ঐতিহ্যবাহী কারখানা নিজ দেশে রেখে বিদেশ থেকে কোচ আমদানি করতে হচ্ছে। ট্রেনগুলো বাইরে থেকে দেখে মনে হলো, দেশটা বুঝি জাপান বা চীন হয়ে গেল।
২০১৩ সালের এপ্রিলে চীনের তাংসান রেলওয়ে ভেহিক্যাল কোম্পানির কাছ থেকে ৬৮৭ কোটি টাকায় সংগ্রহ করা হলো ২০ সেট ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট)। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই চিত্র বদলে গেল। ট্রেনগুলো অনেক উঁচু। জানালাগুলো নেহায়েত ছোট। টয়লেট নেই, যত্রতত্র বিকল হয়ে যায়। শুরু হলো লোকসানের পালা। ফি বছর পালা করে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে শুরু করল শখের ডেমু।
সর্বশেষ ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে লোকসান দিল ৩৪ কোটি টাকা(দৈনিক সমকাল,১৯ অক্টোবর,২০১৬)।
বর্তমান চার সেট ডেমু অকেজো হয়ে ওয়ার্কশপে পড়ে রয়েছে। ১৬ সেটই এই কর্মযজ্ঞ ঘটিয়েছে।বাকি চার সেট মাঠে থাকলে লোকসানের মাত্রা আরো বেড়ে যেত, সন্দেহ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেমুর পিছুনে ৬৮৭ কোটি টাকা গচ্ছা না দিয়ে সমপরিমাণ টাকায় কমপক্ষে ১০টি উন্নতমানের লোকোমোটিভ এবং ১০০টি কোচ কেনা যেত, যেগুলোর অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল হতো ২০ বছর, লাভ হতো প্রচুর।
এমন ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের কারণে ফি বছর লোকাসানের মাত্রা বাড়ছে। গত অর্থ বছরেও
১৬০১ কোটি লোকসান দিয়েছে আমাদের রেলওয়ে। একদিকে রেলের উন্নয়নে কোটি কোটি টাকামূল্যের মাস্টার প্ল্যানের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে লোকসানও।
রেলওয়ের যান্ত্রিক নাট্যমঞ্চে যে মহাকাব্যিক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে তার খবর কজনে রাখে। কিন্তু এটা তো জেনে রাখা উচিত যে, রেলওয়েকে বাঁচাতে হবে।
লেখক : সংগঠক, রেল-নৌযোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।