শাওন কে?
কিছু মানুষের কাছে একটা বিতর্কিত নাম। কিছু মানুষের কাছে একটা সাহসী চরিত্র।
মেহের আফরোজ শাওন। একাধারে নৃত্যশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা।
কিন্তু তাঁকে আমরা অধিকতর চিনি প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী হিসেবে। লেখক নিজেই সব ছেড়েছুড়ে যাঁকে নিয়ে নতুন ঘর বেঁধেছিলেন।
তারপরও দেশে তিন ধরনের মানুষ পাওয়া যায়, যাঁরা শাওনকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে চান না।
এক. বিবাহিত পুরুষদের একাংশ এবং মেয়ের বাবাদের মধ্যে একটা বড় অংশ। শাওনের সাফাই গাইলে অন্যরা ভেবে বসতে পারেন যে, মেয়ের বয়সী মেয়েদের প্রতি এই লোকের আকর্ষণ আছে, এই আশঙ্কায়। আর মেয়ের বাবারা ‘শাওনের মতো মেয়েরা খারাপ’ এই বলে মগজ ধোলাই করে মেয়েকে তাঁর বান্ধবীর বাবার কাছ থেকে নিরাপদে রাখতে চান।
দুই. বিবাহিত নারীরা, যাঁরা মেয়ের বান্ধবীদের কাছে নিজেকে দুর্বল ভাবেন এই ভেবে যে, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক এই কাজ করেছেন, তাঁর স্বামী যদি করে বসেন! স্বামীকে তো আর দোষ দেওয়া যায় না আগ বাড়িয়ে! তাই বাবার বয়সী (বিবাহিত) লোকের সঙ্গে প্রেম বা ঘর করা মাত্রই খারাপ মেয়ে। অতএব, শাওনকে খারাপ বানানোর ব্র্যান্ডিং-এর মাধ্যমে নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার ফাঁকফোকর বন্ধ করার মিছে চেষ্টা করেন তাঁরা।
তিন. এই দুইয়ের বাইরে অনেকেই স্রেফ হুমায়ূনের ভক্ত এবং তাঁর লেখা গোগ্রাসে গিলে পেয়েছিলেন একটা সুখী সংসারের ছবি। বাস্তবে সেই সংসার ভাঙার দুঃখ মুছতে গিয়ে শাওনকে অভিযুক্ত করলেই শান্তি মেলে। শাওনকে অপরাধী সাব্যস্ত করলেই প্রিয় লেখককে যে ফেরেশতার আসনে বসিয়েছিলাম, সেইখানে বসিয়ে রাখা যায়। সত্যি বললে, আমি নিজেও এই শ্রেণির মানুষ। শাওনের বিরুদ্ধে কত স্ট্যাটাস দিয়েছি, ব্যঙ্গাত্মক ব্লগ লিখছি তাঁর ইয়াত্তা নেই। আবেগে, নিজের মনের অজান্তে সমাজের ফ্যাসিবাদী আচরণ আমিও করেছি— নারী হয়ে আরেক নারীর সঙ্গে।
সম্প্রতি এই তিন শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক গোষ্ঠী। পুঁজিবাদী, বেনিয়া গোষ্ঠী। লেখক হুমায়ূনকে ঘিরে আর্ট কালচারের নামে পুঁজির ব্যবসা চলতেই পারে। কিন্তু পুঁজির নামে লেখকের স্ত্রীকে সামাজিকভাবে ধর্ষণের চেষ্টা ভীষণ অরুচিকর। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ চলচ্চিত্র কি এমনি একটি প্রয়াস?
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, দ্বিতীয় বিয়ের পর আমাদের দেশে প্রথম ঘরের সন্তানদের কেউ গুরুত্ব দেয় না। তাঁরা থাকে অবহেলিত। এই ছবিতে সেই বিষয়টা উঠে এসেছে।
হুমায়ূন তাঁর প্রথম স্ত্রী (সাবেক) গুলতেকিন খান ও প্রথম ঘরের সন্তানদের সঙ্গে যদি অবিচার করে থাকেন, তার ফয়সালা করার দায়িত্ব তিনি কাউকে দিয়ে যাননি। আমরা নিজেরা আমাদের জন্মদাতা বাবা-মায়ের পাওনা ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতে পারি না এই জগৎসংসারে, সেইখানে সৎমা হিসেবে শাওন হয়তো তাঁর সৎ ঘরের ছেলেমেয়েদের পাওনা বুঝিয়ে দেননি| আবার হয়তো দিয়েছেন, আমরা জানি না। কারণ, সৎমা যদি কলিজা কেটেও খাইয়ে দেন, তা সৎ ঘরের সন্তানদের মনঃপুত হবে না। অতঃপর, নিজের বাবাকে প্রকাশ্যে কিংবা মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দোষী সাব্যস্ত করা প্রথম ঘরের সন্তানদের পক্ষে সম্ভব না। অন্যদিকে, হুমায়ূন আহমেদের জীবনে শাওন না এলে ঠিকই অন্য আরেক নারী আসত- এই বাস্তবতা প্রথম ঘরের সন্তান হিসেবে চিন্তা করা খুব কঠিন। নিজের বাবাকে নিয়ে যে কমফোর্ট জোন, এ কথা ভাবলে, সেটুকুও নষ্ট হয়ে যায়। ফলাফল, প্রথম ঘরের সঙ্গে দ্বিতীয় ঘরের দ্বন্দ্ব অনিবার্য। যেখানে যিনি এই কর্মটির মূল হোতা, তিনি থেকে যান নিরাপদে।
সামাজিক গণমাধ্যমে কেউ কেউ বলছেন, ‘শাওন যে জিনিস বাস্তবে করেছে, তা চলচ্চিত্রে দেখতে দোষ কী?’ আপনি আপনার স্বামীর সঙ্গে শোবার ঘরের প্রতীকী দৃশ্য কি পর্দায় দেখতে আরাম বোধ করবেন? যেই দৃশ্যে আপনি নেই, আপনার নাম নেই, কিন্তু পত্রিকার সাক্ষাৎকার দেখে আমি জেনে গেছি, মূলত ওটা আপনার শোবার ঘরের কিংবা অন্দরমহলের চিত্র? এবং আপনার স্বামী বেঁচে নেই, ওই দৃশ্য দেখে আপনার সন্তানরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আপনি মানবেন?
ফারুকী কি ছবি বানাতে পারেন?
অবশ্যই পারেন। কিন্তু যেটা পারেন না, সেটা হচ্ছে ছবিতে ‘এটি সম্পূর্ণই কাল্পনিক’ এসব ডিসক্লেইমার দিয়ে ভারতের সাংবাদিক দিয়ে এটি হুমায়ূন আহমেদের জীবনী এই বিষয়ে নিউজ করানো। যদিও ফারুকী অস্বীকার করছেন, কিন্তু বাংলা ট্রিবিউনের তথ্যনুসারে, আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন সাংবাদিক ইন্দ্রনীল বলেছেন, ‘ফারুকী নিজেই শাওন ও শিলা আহমেদের ফোন নম্বর আমাকে দিয়েছেন এবং এটি যে হুমায়ূনের জীবনী অবলম্বনে তা আমাকে নিশ্চিত করেছেন।’
এতে করে এখন এই ছবির কাহিনী কাটছাঁট করে আরো অর্ধেক বদলায়ে ফেললেও এক শ্রেণির মানুষ হলে যাবে এই ছবি দেখতে— হুমায়ূন চরিত্রে ইরফান খান কেমন অভিনয় করল তা দেখতে। আর একটা বিশাল শ্রেণি যাবে দেখতে – এই সম্পর্কে শাওনের ভূমিকা কতদূর ছিল? তা দেখে তাঁরা শাওনের ‘নষ্টামির’ (তাদের চোখে) একটা মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু যদি নষ্টামি হয়েই থাকে সেটার দায় কি শাওনের একার? বরং, স্ত্রী সন্তান রেখে একটি টিনএজার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন — অন্তত সমাজের দৃষ্টিতে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। বয়স বিবেচনায় ‘শাওন’ ইমোশনাল আবিউজ বা মনিপুলেশন এর শিকার— মনোবিজ্ঞানীরা তাই বলবেন।
বিখ্যাত লেখকের বিবাহিত স্ত্রীর ফোন নম্বর যে পরিচালক নিজেই সাংবাদিককে দিয়েছেন, তিনিই পরবর্তীতে বলছেন, ‘শাওন ডুব নিয়ে কথা বলার কে?’
আজ্ঞে মহামান্য, শাওনই একমাত্র বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন লেখকের মৃত্যুশয্যার শিয়র পর্যন্ত। এমন না যে আগের স্ত্রীকে তিনি তালাক দেননি; একসঙ্গে তাঁর দুটি স্ত্রী ছিল। আগের স্ত্রীর বা পরিবারের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব আপনাকে সিনেমা দিয়ে ফয়সালা করার অধিকার কেউ দেয়নি। প্রিয় লেখকের স্ত্রীকে (যেকোন নারীর বেলাতেই এটা সত্য) এভাবে সামাজিক ধর্ষণের আনন্দ উৎসব চলতে দেওয়া যায় না।
ছবির উপজীব্য কী?
আদতে ছবির মূল ফোকাস হুমায়ূন হলেও এই ছবির অন্যতম উপজীব্য বা মূলধন হচ্ছে শাওন চরিত্র। ধর্ষণের ভিডিও বা অমুক তারকার গোপন ভিডিও ফাঁস এগুলোতে অনেক হিট হয়। ফারুকী অস্বীকার করলেও তাঁর ছবির নায়িকা কলকাতার পারনো মিত্র ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, এটি হুমায়ূন আহমেদের জীবনী। আর তিনি অভিনয় করেছেন শাওন-এর চরিত্রে। পরে সেই স্ট্যাটাস তিনি ডিলিটও দিয়েছেন। আর রোকেয়া প্রাচীও একই কথা বলেছেন যে তিনি অভিনয় করেছেন গুলতেকিন-এর চরিত্রে। আইনের মারপ্যাঁচ থেকে বাঁচতে লেখকের ছেলেমেয়ের সংখ্যা সিনেমায় কমিয়ে দেওয়াটা ভালো ছিল, কিন্তু, প্রচার এর উদ্দেশ্যে— সর্বকালের সবচেয়ে হিট বানানোর স্বপ্নে ছবি মুক্তির আগেই ‘আনন্দবাজার পত্রিকায়’ নিউজ করিয়ে যেভাবে জল ঘোলা করা হয়েছে, সেটা মূলত নেতিবাচক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বিষয়টিকে ‘হট কেক’ বানানোর একটা চেষ্টা। এবং শাওনকে ‘চেরি’ ফল বানিয়ে ওই কেকের ওপরে বসিয়ে এমন বাণিজ্য চেষ্টা তাঁকে সামাজিকভাবে ধর্ষণ-চেষ্টার নামান্তর। ফলত, যে আশঙ্কা প্রকাশ করে শাওন চিঠি দিয়েছেন যথাযথ কর্তৃপক্ষকে, সেই আশঙ্কা ভুল প্রমাণ করার দায়িত্ব ফারুকীর।
ছবির মুক্তির পরে কী হবে?
এই ছবিতে যদি দেখানো হয়—শাওনকে নেতিবাচক চরিত্রে, তবে ফারুকীর দুটি লস হবে। এক. এই ছবি কালজয়ী হবে না। কারণ, হুমায়ূন আহমেদকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, শাওন— তাঁর জীবনের শেষ ১৫-২০ বছর। কীভাবে তাদের মধ্যে প্রেম হয়— তা শাওন বাদে কেউ বলতে পারবে না। যাঁরা হুমায়ূন আহমেদের কাছের বন্ধু ছিলেন, তাঁদের এক-একজনের গল্প একেক রকম। এসব গল্পের কোথাও মনে হবে শাওনই সবচেয়ে দোষী, কোথাও মনে হবে শাওন ঘটনার শিকার মাত্র। হুমায়ূন যে রাজার মতো জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখতেন, সেই রাজমহলে তিনি শাওনকেই চেয়েছিলেন। তবে একবাক্যে সবাই একমত যে, হুমায়ূনের জীবনে শাওন একমাত্র নারী নন, কিন্তু কিশোরী শাওনের জীবনে হুমায়ূন ছিলেন প্রথম পুরুষ। একইভাবে ১৪ বছরের কিশোরী গুলতেকিন খানের জীবনেও তিনিই ছিলেন প্রথম পুরুষ।
যদি অন্যায় কিংবা অনৈতিকতার প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করা হয়, তবে লেখকের দিকটাই ভারী। কিন্তু তা যদি সিনেমায় দেখানো হয়, সেই ছবি কি চলবে? অতএব, লেখকের জীবনে আসা দ্বিতীয় স্ত্রীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষা ভাবে ঘায়েল করা একটা অস্ত্র হতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস ফারুকীর মতো একজন পরিচালক এই হীন কাজটা করবেন না। কিন্তু, যদি তিনি তা করে থাকেন, সিনেমা মুক্তির পরে শাওন ও তাঁর দুই সন্তানের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। এতে ফারুকীর চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থাকে। কিন্তু সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেন না। সারা দেশের অসংখ্য ভক্ত, নিজের প্রিয় স্ত্রী, তিন মেয়ে আর একমাত্র ছেলেকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে হুমায়ূন শাওনের সঙ্গে যে জীবন, তা বেছে নিয়েছিলেন। সেই ঘরে পরে তাঁর দুটি ছেলে হয়েছে, তাঁরা কেবল শাওনের একার সন্তান না। হুমায়ূন আহমেদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে (সত্যি কিংবা বাণিজ্যিক কিংবা আবেগবশত) বারবার তাঁর স্ত্রী ও ছোট্ট দুই সন্তানকে আমরা অপদস্থ করছি।
ছবিবিরোধী যারা
যারা এই ছবি মুক্তি না পাওয়ার পক্ষে, তারা সবাই মূলত শাওনের পক্ষে তা না| এদের মধ্যে অনেকেই ফারুকী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কে নিয়ে যাচ্ছেন, এই হিংসা থেকে করছে। ইরফান খানের সঙ্গে তিশা অভিনয় করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করতে যাচ্ছেন, এইটাও অনেকের ঘুম হারামের কারণ। আমাদের দেশে তিশার মতো এমন তুখোড়, মেধাবী অভিনেত্রী খুব কম আছে। একই সঙ্গে ফারুকী যে দেশের অন্যতম তুখোড় চলচ্চিত্র পরিচালক, আর এতে করে তিনি যে অনেকের ঈর্ষার কারণ, তারাও এখন সুযোগটি নিচ্ছেন।
ছবি কি মুক্তি পাওয়া উচিত না?
এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো ছবিতে ইরফান খান অভিনয় করছেন, এই ছবি মুক্তি না পেলে কেবল ব্যবসায়িক লস হবে না, আমাদের চলচ্চিত্রের বিশাল ক্ষতি হবে। তাই ছবিটি মুক্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু নৈতিক অবস্থান থেকে ছবি মুক্তি দেওয়ার আগেই হুমায়ূন আহমেদের পরিবার (যেসব চরিত্র ছবিতে আছে, তারা সবাই) এই ছবি দেখার অধিকার রাখেন। তাঁরা দেখে যদি মনে করেন, না এতে দোষের কিছু নেই, তবেই ফারুকীর উচিত ছবিটি মুক্তির পথে আগানো।
‘ডুব’ নামের বাংলা চলচ্চিত্র ঝড় তুলুক ওপার বাংলায়, এমনকি সারা বিশ্বে।
লেখক : ঔপন্যাসিক