অভিমত
নতুন নির্বাচন কমিশন ও ই-ভোটিং বিড়ম্বনা
নবগঠিত নির্বাচন কমিশন এখন আস্থা ও বিশ্বাস পুনরুদ্ধারে কাজ শুরু করেছে। এর কারণ বিগত কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আস্থা পুনরুদ্ধারে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের যেমন উদ্যোগ রয়েছে তেমনি রাজনৈতিক দলগুল এবং গণমাধ্যম কমিশনকে এ কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এরই অংশ হিসেবে আসন্ন রাঙামাটির বাঘাই ছড়ি পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন করে এলেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। সেখানে ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গত শুক্রবার নির্বাচনের আগের দিন তিনি এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাদের এসব কথা ও কাজের মাধ্যমে যখন আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তারা চেষ্টা করছেন তখন ই-ভোটিংয়ের প্রস্তাব নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিরাজমান সব বিধি-বিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন গঠনে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের এখন থেকেই কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী সংসদে উপস্থাপিত প্রশ্ন-উত্তর পর্বে একপর্যায়ে এ অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জনমানুষের ভোটাধিকার অধিকতর নিশ্চিত করার স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই ‘ই-ভোটিং চালুর বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে’। এ ব্যাপারে বিগত নির্বাচন কমিশন অনেক কাজ করে গেছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে। এ ব্যবস্থাটি বিগত কয়েক বছর ধরে বিতর্কিত হয়ে আসছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বরাবরই ব্যবস্থাটির পক্ষে। বিগত নির্বাচনগুলোয় এর আংশিক প্রয়োগ লক্ষ করা গেছে। গত ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগ ই-ভোটিংয়ের অনুরোধ জানিয়েছিল। অপরদিকে, কার্যত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সব সময়ই যন্ত্র দিয়ে ভোট গ্রহণের বিপক্ষে। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের জবাবে বিএনপি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৭ নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিং করে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ই-ভোটিংয়ের যে কথা বলেছেন, এটি সরকারের ভোটার বিহীন নির্বাচন করার আর একটি ডিজিটাল প্রতারণা কি না, তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক সংশয় দেখা দিয়েছে। আমরা মনে করি তাঁর ঘোষণা জনগণকে আর একটি তামাশার বায়োস্কোপ দেখা ছাড়া অন্য কিছু নয়।’ রিজভী আরো দাবি করেন, এটি জনগণের ভোটকে নিজ উদ্দেশ্য সাধনে জালিয়াতি করার প্রচেষ্টা মাত্র। এটি প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি ভেলকিবাজির-ই বর্ধিত প্রকাশ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী এখন জনগণের দৃষ্টিকে সিইসির দিক থেকে অন্যত্র সরানোর জন্য ই-ভোটিং ব্যবস্থার আর একটি ম্যাজিক জনগণের সামনে প্রদর্শন করছেন।
শুরুতেই এ ধরনের নীতিনির্ধারণী প্রশ্নে বিতর্ক নতুন নির্বাচন কমিশনকে বেকায়দায় ফেলবে। নির্বাচন ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। কিন্তু কার্যত সরকারের অধীন। বিগত প্রায় ৫০ বছরের বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে কখনোই নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেনি। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয় যে, ‘ইসির নিরপেক্ষতার বড় বাধা রাজনীতিকরণ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণই নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীনদলগুলো নিজেদের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার জন্য পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে রাজনীতিকরণ করেছে। কমিশনের নিয়োগ থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ধাপে দলীয় রাজনীতির ছোয়া বিদ্যমান।
ই-ভোটিংয়ের পরিবর্তে নতুন যন্ত্রটির সম্ভাব্য নাম ডিজিটাল ভোটিং মেশিন (ডিভিএম)। বাংলাদেশে এর আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সীমিতভাবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা এবং মেশিনের অকার্যকারিতায় তা ব্যবহার করা যায়নি। নতুন মেশিন (ডিভিএম) সম্পর্কে একই ধরনের নেতিবাচক মনোভাব বিরাজ করছে সর্বত্র। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, শিক্ষাগত অবস্থান এবং সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে যান্ত্রিক ভোটিং বাস্তব সম্মত নয়। এ কথাও ঠিক যে, আমাদের গতানুগতিক পদ্ধতি আকড়ে ধরে থাকলে চলবে না। আমাদেরও এগুতে হবে আধুনিকায়নের পথে, তবে তা হবে ধীরে ধীরে, ক্রমান্বয়ে, পরিকল্পনা মাফিক। তবে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা অনুকূল নয়। ২০১২ সালের মার্কিন নির্বাচনে ফ্লোরিডায় এই ভোটিং পদ্ধতি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। অবশেষে, সুপ্রিম কোর্টে তা মীমাংসিত হয়। উল্লেখ্য যে, ভারত, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডেও এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এ পদ্ধতিতে দূর থেকে হ্যাক করা সম্ভব বলেই স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে ওই সব দেশে এ পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন সম্পর্কে সব সময়ই ‘সূক্ষ’ অথবা ‘স্থূল’ কারচুপির অভিযোগ করে আসছে। বিশেষত বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ওপর বড় ধরনের আস্থাহীনতার নজির সৃষ্টি হয়েছে। এ সরকারের অধীনে স্থানীয় সব নির্বাচনে হত্যা, সহিংসতা ও ব্যাপক কারচুপির খবর প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং সংবিধান মোতাবেক ২০১৯ সালের অনুষ্ঠতব্য নির্বাচন সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর আশঙ্কা অমূলক নয়। এ ক্ষেত্রে সদ্য গঠিত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে এগুতে হবে। জনগণ প্রধান নির্বাচন কমিশনের প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রাখতে চায়। কারণ, তিনি কর্মকর্তাদের সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনের দিকে কেবল দেশবাসী নয়, আন্তর্জাতিক মহল তাকিয়ে আছে।’ সিইসি যথার্থই বলেছেন।
ইতিমধ্যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের আরো একটি বড় বাধা নির্বাচনকালীন সরকার । বাংলাদেশের বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশনের সহৃদয়তা, আন্তরিকতা ও দৃঢ়তা সবকিছুই ভেস্তে যাবে যদি সে সময়ের সরকারটি নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল না হয়। নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিরোধী দল বিশেষত বিএনপিকে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। সীমিত সুযোগের মধ্যে জনমত গঠন এবং গণমাধ্যমকে সরব করতে হবে। অবশেষে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধ পরিকর হতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।