জাতীয় নির্বাচন
সবার দৃষ্টি রাষ্ট্রপতির দিকে
রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সর্বত্রই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রাষ্ট্রপতির সংলাপ শেষ হয়েছে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি দেশের উল্লেখযোগ্য ৩১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রপতি সবার কথা শুনেছেন। দলগুলোর কাছ থেকে শতাধিক প্রস্তাব পেয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে এই আলোচনার মধ্য দিয়ে দলগুলো এক ধরনের আশ্বস্ত হয়েছে যে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি কার্যকর ভূমিকা রাখবেন। সংলাপ শেষে এমন আশার বাণী আমরা মোটামুটি প্রায় সব দলের প্রেস ব্রিফিংয়েই শুনেছি। এমনকি খোদ বিএনপিও এমনটা আশা করছে যে রাষ্ট্রপতি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে সক্ষম হবেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ অনেক দলই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন। সময় স্বল্পতার কারণে অনেকে আবার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে হলেও নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে একটি স্থায়ী প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
আইনমন্ত্রী অবশ্য খুব খোলামেলাই বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন এত তাড়াতাড়ি করা উচিত হবে না। বিশিষ্টজনদের অনেকে তাই মনে করছেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ। এই সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতা রয়েছে। এরই মধ্যে আবার সংসদ অধিবেশন শুরু হচ্ছে ২২ জানুয়ারি থেকে। কাজেই এত অল্প সময়ে কোনো আইন বা অধ্যাদেশ জারি করে এবারের মতো অন্তত নির্বাচন কমিশন গঠন করা যাচ্ছে না- এটা নিশ্চিত। ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রনয়ণ করা হবে সেই প্রত্যাশায় রইলাম। বর্তমানে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতা মহামান্য রাষ্ট্রপতির। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের সেই পুরনো পথেই হাঁটবেন যেমনটা আমরা অতীতে দেখেছি। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রপতির যে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা এবং সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তা কাজে লাগিয়ে সার্চ কমিটি দিয়ে একটি বিতর্কমুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন- এমনটা রাষ্ট্রের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রত্যাশা করতেই পারি। তারপরও সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া রাষ্ট্রপতির একার পক্ষে তা কতটুকু সম্ভব, সেটা এখন ভেবে দেখার বিষয়।
যে সরকারই ক্ষমতায় গেছে সর্বদা চেষ্টা করেছে নির্বাচন কমিশনকে তাদের মতো করে সাজাতে। ফলে যে সরকারই নির্বাচন কমিশন গঠন করে বিরোধীদল কোনোভাবেই সেই কমিশনকে মানতে পারে না। বরং কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে সেই চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। আবার অনেক সময় নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডও তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর কোনো কালেই সব দলের আস্থা ছিল না। বরাবরই প্রতিটি সরকারি দলই নির্বাচন কমিশনের যেকোনো অন্যায় কাজকেও সাফাই গেয়ে বৈধতা দিয়েছে কিংবা চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে যারাই নির্বাচনে হেরে গেছে যত ভালো এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই হোক না কেন তারা তখন নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর। ভালো কাজকে ভালো বলতেও আমরা হীনমন্যতায় ভুগি।
ড. এ টি এম শামসুল হুদার কমিশন একটি সুন্দর সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার পরও আমরা সবাই এ কথা সমস্বরে বলতে পারিনি যে নির্বাচনটি ভালো হয়েছিল কিংবা অবাধ সুষ্ঠু হয়েছিল। হেরে গেলেই ভালোকে আর ভালো বলতে পারি না। এই সংস্কৃতি যত দিন পরিবর্তন না হবে তত দিন কোনো নির্বাচন কমিশনের পক্ষেই সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। প্রতিবারই নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিবদমান দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়ে এসেছে। এবং যা শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় রূপ নিতেও আমরা দেখেছি।
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন একজন রাষ্ট্রপতির জন্যও অত্যন্ত কঠিন কাজ। একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে নতুন নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করছে দেশের আগামীর রাজনীতি। নতুন যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে তাদের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কাজেই সব দলের কাছে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন যদি গঠন করা যায় তবে বিএনপিসহ সব দল আগামী নির্বাচনে আস্থার সঙ্গে অংশগ্রহণ করবে এমনটা আসা করা বোধহয় ভুল হবে না। যা দেশের গণতন্ত্রকে আরো সুসংহত করবে। একটি গ্রহণযোগ্য আস্থাশীল, দায়িত্বশীল এবং সাংবিধানিক দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতি মহোদয় গঠন করতে পারেন তবে বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে আসবে এবং না এলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ থাকলেও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার মধ্য দিয়ে বিদায়ী কমিশনও প্রমাণ করতে পেরেছে তারাও চাইলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারত। সরকারের সদিচ্ছা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচন কমিশনের সুদৃঢ় ভূমিকা থাকলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা কোনো কঠিন কাজ নয়।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আর তাই রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে পুরো জাতি তাকিয়ে আছে কেমন নির্বাচন কমিশন আসছে আগামীর জন্য। খুব সঙ্গত কারণেই সবার দৃষ্টি এখন রাষ্ট্রপতির দিকে। তিনি কেমন নির্বাচন কমিশন জাতিকে উপহার দিবেন এই দিকেই মুখিয়ে আছে সবাই।
লেখক : বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।