রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় ছিল ‘হাবিব ব্যাংক’। ১৯৭১ সালের আগে ওই ব্যাংক থেকেই টাকা লেনদেন করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সব ধরনের লেনদেন হতো ওই ব্যাংকেই।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে প্রশাসনিক ভবনের গেটে প্রহরীর দায়িত্বে ছিলেন নৈশপ্রহরী আবদুর রাজ্জাক। প্রশাসনিক ভবনের কলাপসিবল গেটের সামনে নিজের দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। ওই রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল প্রশাসন ভবনের সামনে এসে আবদুর রাজ্জাককে গেট খুলতে বলেছিল। তাদের হয়তো উদ্দেশ্য ছিল, ‘হাবিব ব্যাংকের টাকা ও মূল্যবান কাগজপত্র লুট করা’ (এপ্রিলের মাঝামাঝিতে অবশ্য সেই ব্যাংক লুট করে ওই হায়েনার দল)। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক সেনাবাহিনীর অস্ত্রের মুখেও গেট খুলতে রাজি হননি। নিজের জীবনের চেয়ে দায়িত্বকে বড় করে দেখেছেন। তার মাশুলও দিতে হয় তাঁকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হায়েনারা আবদুর রাজ্জাককে গুলি ও পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা করে। একাত্তরে তিনিই হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ।
২৬ মার্চ সকালে আবদুর রাজ্জাকের লাশ প্রশাসন ভবনের ভেতরে দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে পড়ে ছিল। ওই দিন দুপুর পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাকের লাশটির কোনো সৎকার হয়নি। ওই সিঁড়িতেই পড়ে ছিল। তাঁর রক্তে পুরো এলাকা ভরে ছিল। কেউ ভয়ে তাঁকে নিতে আসেনি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হলের প্রহরী মো. সদরউদ্দিন লাশটি শ্যামপুর নিয়ে যান। সেখানেই আবদুর রাজ্জাকের বাড়ির পাশে তাঁর কবর দেওয়া হয়।
সেই মাটির নিচেই চাপা পড়ে একটি ইতিহাস, যা আর আমাদের সামনে খুব একটা আলোচিত হয়নি। তাঁকে কেউ আর মনেও রাখেনি। তাঁর পরিবার, স্ত্রী ও দুই সন্তান পরে কীভাবে জীবন নির্বাহ করেছেন, তা-ও আমরা জানি না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী কিংবা শিক্ষার্থীরা হয়তো এখন আবদুর রাজ্জাক নামটিই ভুলে গেছেন।
অথচ তাঁর রক্তের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আজকের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আবদুর রাজ্জাকের দায়িত্ববোধ আমাদের অনেক কিছু শেখায়। তাঁর আত্মদান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকার কথা ছিল। তাঁর স্মৃতির স্মরণে অন্তত একটি ফলক তৈরি করা যেত। কিন্তু সেটা আমাদের চোখে পড়েনি। দেশ স্বাধীনের ৪৫ বছর পার করলেও সেই রাজ্জাককে আমরা সম্মান দিইনি। মহান বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সভা-সেমিনার হলেও তাতে উচ্চারিত হয় না আবদুর রাজ্জাকের নাম।
কিন্তু আবদুর রাজ্জাক যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হতেন, তাহলে কি তাঁকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হতো? হয়তো সেটা কখনই সম্ভব হতো না। তিনি যে একজন প্রহরী। সাধারণ কর্মচারী। তাঁর জীবন বা তাঁর পরিবারের জীবিকা নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাকবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ ওই রাজ্জাকের মতো বীর বাঙালিদের কারণেই নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়। আমরা পাই একটি মুক্ত বাংলাদেশ।
কয়েক দিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদের জানতে চেয়েছিলাম। সেখানে কেউ আবদুর রাজ্জাকের নামটি বলতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী মন্তব্য করেছেন, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ। অথচ তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ নম্বর কোয়ার্টার থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায় ১৪ এপ্রিল। তাঁর স্ত্রী চম্পা সমাদ্দারের ধারণা, ‘ধরে নিয়ে যাওয়ার পরের দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের ওই অধ্যাপককে হত্যা করে হায়েনারা।’
মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবদান কম ছিল না। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯ জন শহীদ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নয়জন শিক্ষার্থী, পাঁচজন সহায়ক কর্মচারী ও ১১ জন সাধারণ কর্মচারী।
শহীদ শিক্ষকরা হলেন—বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের হাবিবুর রহমান, মনোবিজ্ঞান বিভাগের মীর আবদুল কাইয়ুম ও সংস্কৃত বিভাগের সুখরঞ্জন সমাদ্দার।
শহীদ ছাত্ররা হলেন—আবদুল মান্নান আহমেদ (স্নাতক সম্মান শ্রেণি, দ্বিতীয় বর্ষ, বাণিজ্য বিভাগ), আমীরুল হুদা জিন্নাহ (এমএ শেষ বর্ষ, বাংলা বিভাগ), গোলাম সরওয়ার খান সাধন (পূর্ব বিভাগ, এমএসসি), প্রদীপ কুমার রাহা (রসায়ন বিভাগ), মোহাম্মদ আলী খান (প্রথম বর্ষ, অর্থনীতি বিভাগ), শাহজাহান আলী (বাণিজ্য বিভাগ), মিজানুল হক (এমএসসি, পূর্ব ভাগের পদার্থবিদ্যা বিভাগ), ফজলুল হক, আ. লতিফ ও রেজাউল করিম।
শহীদ সহায়ক কর্মচারীরা হলেন—শেখ এমাজ উদ্দিন (স্টোন টাইপিস্ট, প্রশাসন শাখা), এস এম সাইফুল ইসলাম (উচ্চমান সহকারী, হিসাব বিভাগ), মো. কলিমউদ্দিন (কর্মসহকারী, প্রকৌশল দপ্তর), আবুল হোসেন (পরিবহন শাখার ড্রাইভার) ও শফিকুর রহমান (কাঠমিস্ত্রি, প্রকৌশল দপ্তর)।
শহীদ সাধারণ কর্মচারীরা হলেন—আবদুর রাজ্জাক (নৈশপ্রহরী, প্রশাসন ভবন), মোহনলাল (সুইপার, স্টুয়ার্ড শাখা), নূরু মিঞা (প্রহরী, স্টুয়ার্ড শাখা), মোহাম্মদ ইউসুফ (উপাচার্য অফিসের জরুরি পিয়ন), মো. ওয়াজেদ আলী (পিয়ন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর), মো. আফজাল মৃধা (প্রহরী, উপাচার্য দপ্তর), ওয়াহাব আলী (অর্ডালি পিয়ন, প্রক্টর দপ্তর), আবদুল মালেক (বেয়ারা, আইন বিভাগ), কোরবান আলী (প্রহরী, ভূগোল বিভাগ), ইদ্রিস আলী (পানিবাহক, সৈয়দ আমীর আলী হল) ও মো. আবদুল মজিদ।
দীর্ঘ এ তালিকার সর্বশেষ ভাগে রয়েছে আবদুর রাজ্জাকের নাম। একাত্তরে শহীদদের স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক স্মৃতিফলক ও স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ২৫ মার্চে প্রথম শহীদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও কোনো স্মৃতিফলক আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে বলে আমরা আশা করি। আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রী-সন্তানদের খোঁজ নেবে, যাতে করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। সম্মান দিতে পারে আবদুর রাজ্জাকের মতো দেশপ্রেমিককে।
তথ্যসূত্র : বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা ও নাজিম মাহমুদের স্মতি ’৭১ গ্রন্থ ‘যখন ক্রীতদাস’।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সাংবাদিক।