বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস
প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হোক
২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮৯ লাখ ৫৭ হাজার ৭৪৫ জন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশের পূর্ণবয়সী মানুষের শতকরা ১৬ দশমিক ১ ভাগ মানসিকভাবে অসুস্থ। পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর এই পরিসংখ্যান সত্য ধরে নিলে এখন দেশে আনুমানিক দুই কোটি ৭২ লাখ দুই হাজার ১৯৭ জন মানসিক রোগী আছেন। তাঁদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। দেশে দুইশজনের মতো মানসিক রোগের ডাক্তার বা সাইকিয়াট্রিস্ট এবং ৪৫ জন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ১৩৪ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ৭৬ জন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, ৬৬ জন এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট, ২২ জন শিশু বিকাশ কেন্দ্রে কর্মরত চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, ১৯২ জন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ৬৪ জন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট, ২১০ জন ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কার, ২০০ জন বিএসএমএমইউ-এ অনারারি ট্রেইনিং ইন সাইকোথেরাপি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাজীবী, ৫২ জন টিএ অ্যান্ড এনএলপি কাউন্সেলিং সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কাউন্সেলর ও স্বল্পমেয়াদি কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অজানা সংখ্যক কাউন্সেলররা রয়েছেন। মানসিকভাবে অসুস্থ এই বিপুল জনগগোষ্ঠীর সেবাদানে বিদ্যমান সেবাদাতার সংখ্য কত কম, তা সহজেই অনুমেয়।
দেশে যত মানসিক রোগী আছে, তার থেকেও কয়েক গুণ বেশি আছেন, যাঁরা তীব্র মানসিক চাপে আছেন। তাঁরা যদিও অসুস্থ নন, তবে ভবিষ্যতে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। এ ছাড়া ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস এগুলোর কোনো অভাব নেই। যোগ হয়েছে ভূমিকম্পের বিপদ। আছে জিম্মি হওয়া বা সহিংসতার বিপদ। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যায়। এ ধরনের প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট বিপদের সময় মানুষের মানসিক চাপ বাড়ে ও মানসিক রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
এত অল্প সেবাদাতা নিয়ে কীভাবে আমরা এই ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সেবা দেব? এরই সমাধান হিসেবে ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ’ নামে একটি সংস্থা ‘সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড’ বা প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা বলে একটি ধারণাকে ব্যবহারের প্রস্তাব করছে। কেউ হাত ভেঙে গেলে বা কেউ আহত হলে যেমন সচেতন মানুষ তার প্রাথমিক পরিচর্যা করে সম্ভাব্য স্বল্প সময়ে চিকিৎসকের কাছে নেন, তেমনি মানসিক চাপ ও অসুস্থতারও প্রাথমিক পরিচর্যা করা সম্ভব। এ ধরনের পরিচর্যার জন্য দরকার ভালো মানুষ হওয়া, মানুষের জন্য মায়া থাকা ও ‘সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইডের’ ওপর সীমিত প্রশিক্ষণ। এর জন্য মনোবিজ্ঞানী বা ডাক্তার কিছুই হওয়ার প্রয়োজন নেই। যে কেউই সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড দিতে পারেন। পৃথিবীর অনেক যুদ্ধ, মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত দেশে এ ধরনের ফাস্ট এইড ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। আমরা এর সফল প্রয়োগ শুরু করতে পারি। এতে বিশেষজ্ঞ সেবার আগেই মানুষ একটা তাৎক্ষণিক প্রাথমিক সেবা পাবে। এতে তাঁর মধ্যে পুরোমাত্রায় মানসিক বিপর্যয় ঘটবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১১ সালের এ বিষয়ক গাইডের মতে ‘সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইডের’ নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে :
১. বিপর্যস্ত বা বিপন্ন মানুষের জন্য বাস্তব সমর্থন দেওয়া। তবে জোর করে কোনো সমর্থন দেওয়া চলবে না।
২. মানুষের কী প্রয়োজন এবং এই বিপন্ন মানুষগুলো নিজেদের কী প্রয়োজন মনে করছে, তা মূল্যায়ন করা।
৩. মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার চেষ্টা করা, যেমন : খাবার, পানি, তথ্য, আশ্রয় ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।
৪. মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শোনা। তবে কথা বলার জন্য তাকে চাপ না দেওয়া।
৫. সান্ত্বনা ও সমর্থন দেওয়া।
৬. প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া, কী কী সাহায্য আছে তা জানানো।
৭. অধিকতর যেন ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা, অর্থাৎ নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যারা ‘সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড’ দেবে তাদের মানুষ কতটা বিপন্ন হয়েছে, বিপন্ন হওয়ার প্রকৃতিটি কী, এই মানুষগুলোর জন্য কী কী প্রয়োজন, বিপন্ন মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আছে কি না, যাদের কোনো বিশেষ প্রয়োজন আছে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। ‘সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড’ দেওয়ার সময় বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর, যেই মানুষদের পঙ্গুত্ব আছে, যেমন : শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী মা—এ ধরনের মানুষদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। সেবাদাতাদের যাঁদের তাঁরা সেবা দিচ্ছেন, সেই মানুষের প্রতি, তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি সংবেদনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সেবাদাতাদের নিজেদের যত্ন গ্রহণ সম্পর্কেও যত্নশীল হতে হবে। কোনো বড় ধরনের দুর্যোগের পর ত্রাণ তৎপরতায় অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলে ‘সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড’ দেওয়া উত্তম। ‘সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইড’ জটিল নয় মোটেও। ‘সাইকোলজিক্যাল ফাস্ট এইডের’ মতোই প্রায় একই ধরনের আরেকটি ধারণা হচ্ছে ‘মেন্টাল হেলথ ফাস্ট এইড’। বাংলাদেশে ‘ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং’ বলে একটি সংগঠন এর ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। নেটে সার্চ দিলেই তাদের তথ্য পাওয়া যাবে।
১০ অক্টোবর ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ’ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতৃত্বে ২০০৩ সাল থেকে নিয়মিত পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরে এই দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদাবোধ : সবার জন্য প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা’। এই স্লোগানটি বাস্তবায়ন করলে সীমিত জনশক্তি নিয়েও আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ ও মানসিক অসুখের ঝুঁকিতে থাকা মানসিক চাপগ্রস্ত মানুষদের সেবা নিশ্চিত করতে পারব। মানসিক রোগীরা পূর্ণ মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে তাদের ন্যয্য সম্মান অর্জন করুন, আমরা সবাই সবার জন্য ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিই, জীবন সুন্দর হোক, বঞ্চনা ও বদ্ধমূল ভুল ধারণার অবসান হোক—সে প্রত্যাশায় শেষ করছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।