ডায়াবেটিসে চোখের রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধ জরুরি
ডায়াবেটিসে চোখের রোগ হতে পারে। একে বলে ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৫১৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. জহিরুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : চোখ সম্পূর্ণ ভালো রাখতে কোন কোন বিষয় অক্ষত রাখা প্রয়োজন?
উত্তর : আল্লাহপাক আমাদের সুন্দর একটি চোখ দিয়েছেন, এই সুন্দর বিশ্বকে দেখার জন্য। আমাদের এ দৃষ্টি যাতে অক্ষত থাকে, চোখের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। এগুলো অক্ষত থাকতে হবে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো চোখের সবচেয়ে সামনে একটি স্বচ্ছ অংশ, যাকে কর্ণিয়া বলা হয়। চোখের মণি যাকে বলা হয়, একে আমরা বলি কর্ণিয়া। সেই কর্ণিয়াটা স্বচ্ছ থাকতে হবে। এর পর ঠিক চোখের গোলকের মাঝখানে লেন্স রয়েছে। এটা প্রাকৃতিক লেন্স। সেটাও খুবই স্বচ্ছ। সেটা স্বচ্ছ থাকতে হবে। এর পর লেন্সের পেছনে আছে জেলির মতো পদার্থ। সেটাও কিন্তু স্বচ্ছ। তার পেছনে আছে আলোক সংবেদনশীল পর্দা রেটিনা। সেই রেটিনাটাও স্বচ্ছ। এর কাজ হচ্ছে, দৃশ্যমান বস্তুকে ইমপালসের মাধ্যমে অপটিক নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠানো। মস্তিষ্কের মাধ্যমে আমরা দেখি। তাহলে এই অংশগুলো কর্ণিয়া লেন্স, জেলির মতো পদার্থ ভিট্রাস, রেটিনা, অপটিক নার্ভ এই অঙ্গগুলো ভালো থাকতে হবে, যদি আমরা দেখতে চাই।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিসের সঙ্গে চক্ষুরোগের সম্পর্ক কোথায়? কী কী ধরনের চক্ষুরোগ ডায়াবেটিসের সঙ্গে রয়েছে?
উত্তর : ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, সেটা আমাদের দেহকে যেমন বহুমাত্রিকভাবে আক্রান্ত করে, ঠিক আমাদের চোখকেও বহুমাত্রিকভাবে আক্রান্ত করে। ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রিত না থাকে, তাহলে চোখের লেন্সের ভেতর রিফ্লেকটিভ ইনডেক্স, ডায়াবেটিস যখন বেড়ে গেল, তখন গ্লুকোজ চোখের লেন্সে ঢুকে যাচ্ছে। এটি লেন্সের ভেতর ঢুকে লেন্সকে ফোলাচ্ছে। তখন চোখটা মায়োপিয়া, মাইনাস পাওয়ারের দিকে চলে যাচ্ছে। আবার যখন ডায়াবেটিস বেশি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলছি, তখন সুগারটা বেড়ে যাচ্ছে, লেন্সটা পাতলা হয়ে যাচ্ছে। এতে রিফ্লেকটিভ ইনডেক্স কমে গিয়ে লেন্সটা প্লাসের দিকে চলে যাচ্ছে।
একই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি, তার ডায়াবেটিস যদি বেশি বেড়ে যায়, আবার ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, দিনের বিভিন্ন সময়ে কখনো প্লাসের দিকে চলে যাচ্ছে, তখনো মাইনাসের দিকে চলে যাচ্ছে। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে চোখের কর্ণিয়া যেটা, সম্মুখভাগে চোখের যে মণি তার সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। তাতে যেকোনো সময় জীবাণু বা যেকোনো আঘাতের কারণে, সেখানে ঘা হয়ে যেতে পারে। চোখের মণি বা কর্ণিয়ায় যদি ঘা হয়ে যায়, তাহলে আমাদের দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যাবে। এরপর পেছনে চোখের রেটিনা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ডায়াবেটিসে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জন্য রেটিনা আক্রান্ত হয়। সেখানে যে সূক্ষ্ম রক্তনালি রয়েছে, সেই রক্তনালিগুলোর আবরণ, ভেতরের আবরণ ও বাইরের আবরণ, এগুলো ঝাঁঝরা হয়ে যায়। রক্তনালি থেকে তখন রক্তের বিভিন্ন উপাদান জলীয় পদার্থ, বিভিন্ন ধরনের কোষ, চর্বি রেটিনার বিভিন্ন স্থানে এগুলো সঞ্চিত হয় এবং রেটিনার স্বচ্ছতা নষ্ট হয়। এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ যদি হয়, সেই রক্তটি জেলির মতো যে ভিট্রাস আছে, এখানে চলে আসে। তখন দৃষ্টির স্বচ্ছতা নষ্ট হয় এবং আমাদের দৃষ্টি নষ্ট হয়। এভাবে ডায়াবেটিস বহুমাত্রিকভাবে আমাদের চোখকে আক্রান্ত করে এবং আমাদের চোখকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
প্রশ্ন : যে ব্যক্তি ডায়াবেটিসে অনেক দিন ধরে ভুগছেন, তিনি চোখকে ভালো রাখার জন্য কী করবেন?
উত্তর : আমি যেহেতু জেনে ফেলেছি, আমার চোখের ক্ষতি করছে ডায়াবেটিস। সুতরাং ডায়াবেটিসকে সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। ‘সুনিয়ন্ত্রিত’ শব্দটি একটু বোঝার বিষয়। ডায়াবেটিস সব সময় নিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে। একদিন হঠাৎ করে খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করলাম, আবার গা ছেড়ে দিলাম, খবর নাই, তাহলে হবে না। নিয়মিত নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটা সব সময় স্থায়ী হতে হবে। তাহলে এই ডায়াবেটিস আমার চোখের সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলোর ওপরে প্রভাব ফেলবে না। মাইক্রো এনজিওপ্যাথি হবে না। তাহলে আমাকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাকে নিয়মানুবর্তী জীবনযাপন করতে হবে। শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে হবে। আমাকে ব্যায়াম করতে হবে। খাবারের মেন্যু মেনে চলতে হবে। আমার যদি প্রয়োজন হয়, যদি চিকিৎসক বলেন আমাকে ট্যাবলেট খেতে হবে। যদি ইনসুলিন দিতে বলেন, সেটা নিয়মিত দিতে হবে। পাশাপাশি প্রায়ই চেকআপ করতে হবে। ডায়াবেটিস হলে আপনাকে মেনে নিতেই হবে, এটি হলে চোখ আক্রান্ত হতে পারে। সুতরাং একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে চোখ নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করাতে হবে। সবচেয়ে ভালো হলো চোখের চিকিৎসকদের মধ্যে এখন আবার রেটিনা বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাদের দিয়ে রেটিনা চেকআপ করানো, যে রেটিনাতে কোনো সমস্যা হলো কি না।
এই চেকআপ কত দিন পর পর হবে? এটা নির্ভর করবে আপনার ডায়াবেটিসের অবস্থার ওপর। আপনাকে ঘন ঘন চেকআপ করাতে হবে। আর যদি সুনিয়ন্ত্রিত থাকে, রেটিনোপ্যাথি হয়তো হয়নি এবং আপনি খুব নিয়মানুবর্তী জীবনযাপন করছেন, তাহলে আপনি বছরে একবার দেখালে হবে। কিন্তু যদি আপনার ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু আপনি নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছেন, তাহলে আপনাকে ছয় মাস পর পর দেখাতে হবে। ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি হয়ে গেছে, কিন্তু আপনি নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় নেই, আপনাকে তিন-চার মাস পর পর চোখের চিকিৎসক দেখাতে হবে।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি হলে কী কী লক্ষণ প্রকাশ পায়?
উত্তর : ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি এমন একটি বিষয়, যখন আপনি বুঝতে পারবেন দৃষ্টি কমে গেছে, আপনার চোখের সামনে গুঁড়া গুঁড়া কিছু ভাসছে, চোখের সামনে কালো পর্দার মতো ভাসছে, রেখা, রেখার মতো ভাসছে, কালো কালো ছোপ চোখের সামনে ভাসছে, এগুলো হলো আপনি যখন লক্ষণ বুঝতে পারবেন। তত দিনে কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে লক্ষণের জন্য নির্ভর করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশের আগে প্রতিরোধ ও চিকিৎসাটা খুব জরুরি।
আমাদের অত্যন্ত মন খারাপ হয়ে যায়, যখন দেখি যে ৪২/৪৩ বছরের একটি মানুষের ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথির জন্য চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এবং এমন অবস্থায় সে হয়তো আমাদের কাছে এসছে, যার জন্য কিছু করার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। যদি জিজ্ঞেস করি, আপনি বুঝলেন কবে? সে বলে মাসখানেক আগে বা ১৫/২০ দিন আগে সে বুঝতে পেরেছে। সুতরাং লক্ষণগুলো আসলে সমস্যাটি প্রতিরোধের জন্য কার্যকর বিষয় নয়।
আমাকে যেটা করতে হবে, আমার ডায়াবেটিস আছে, সুতরাং আমাকে নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে যে চোখ ঠিক আছে কি না।
একে আমরা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি স্ক্রিনিং বলি। বিভিন্ন উন্নত দেশে, সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি প্রটোকলের মাধ্যমে স্ক্রিনিং পদ্ধতি তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে সরকারি পর্যায়ে এখনো স্ক্রিনিং পদ্ধতিটা তৈরি হয়নি। বেসরকারি পর্যায়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একটু একটু চেষ্টা করছে। ভিশন চক্ষু হাসপাতালে আমরা কিছু স্ক্রিনিং চালাচ্ছি। আমরা একটি পদ্ধতি তৈরি করেছি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির স্ক্রিনিং চালাচ্ছি। এর মাধ্যমে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের তালিকার আওতায় এনে স্ক্রিনিং করা হয়। ফটোগ্রাফ করে আমরা গ্রেড করে দিচ্ছি। সুতরাং ছয় মাস পর পর বা এক বছর পর পর চেকআপে আসতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি কীভাবে চলতে হবে এবং কোন অবস্থায় কী হলে তাকে যোগাযোগ করতে হবে। এ রকম পদ্ধতি বিভিন্ন হাসপাতালে করা উচিত। না হলে ডায়াবেটিসজনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধ করা যাবে না।