ওজন বেশি হলে কখন সার্জারি লাগবে
ওজনাধিক্য বা স্থূলতা একটি বড় ধরনের সমস্যা। এ জন্য অনেক সময় সার্জারি করার প্রয়োজন পড়ে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩৬৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. সরফরাজ বেগ। বর্তমানে তিনি বেলভিউ হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : স্থূলতা বা ওবেসিটি বলতে আমরা আসলে কী বুঝি?
উত্তর : ওবেসিটি বা স্থূলতার বিষয়টা এখন আমরা বিশ্লেষণ করতে পেরেছি। আগে আমরা বলতাম, লোকটা একটু মোটাসোটা বা খুব রোগা। তবে এর কোনো মাপ ছিল না। এখন কিন্তু আমরা মাপতে পারি। কীভাবে মাপ হয়? একজনের উচ্চতা নিয়ে এবং ওজন নিয়ে একটি পদ্ধতি করি, একে বলি বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই)। সেখানে যদি আমি ওজনকে কেজিতে আর উচ্চতাকে মিটার স্কয়ার ভাগ করি, তাহলে যদি ২০ থেকে ২৫ আসে, এটা স্বাভাবিক। ২৫ থেকে যদি ৩০ থাকে, তাহলে বেশি ওজন। আর ত্রিশের ওপরে যদি থাকে, তাহলে একে আমরা বলি ওজনাধিক্য। যাদের বডিমাস ইনডেস্ক ত্রিশের ওপরে, তাদের আমরা ওজনাধিক্য বলি। নারীর সাধারণত উচ্চতা হয় পাঁচ ফুট দুই বা পাঁচ ইঞ্চি, আর পুরুষদের হয় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি থেকে ১১ ইঞ্চি অবধি। সাধারণত একজন মহিলার যদি ৯০ কিলোর ওপরে থাকে ওজন, আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ১০০ কিলোর ওপরে থাকে, তাহলে আমরা ধরে নেব স্থূলতা আছে। এ রকম ধরে রাখতে হবে।
প্রশ্ন : ওজন বেশি হলে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কী হওয়া উচিত?
উত্তর : ওজনাধিক্য আগে আমাদের নির্ণয় করতে হবে এটা কেমন? মাইল্ড, মডারেট, সিভিয়ার। এখানেও মাপের বিষয় আছে। যদি বডি মাস ইনডেস্ক ৩০ থেকে ৩৫ হয়, একে বলি মাইল্ড ওবেসিটি, ক্লাস ওয়ান ওবেসিটি। যদি বিএমআই থাকে ৩৫ থেকে ৪০, তাহলে আমরা বলি ক্লাস-২ ওবেসিটি বা মডারেট ওবেসিটি। কিন্তু যদি বডি মাস ইনডেস্ক চল্লিশের ওপরে চলে যায়, তখন আমরা বলি সিভিয়ার ওবেসিটি, অথবা মরবিট ওবেসিটি, অথবা ক্লাস-৩ ওবেসিটি।
যখন পঁয়ত্রিশের নিচে আসে, তখন ক্লাস ওয়ান ওবেসিটি। ডায়েট করলে আর একটু শারীরিক পরিশ্রম করলে এ ক্ষেত্রে মানুষের ওজন কমতে পারে। কিন্তু পঁয়ত্রিশের ওপরে গেলে তাহলে ডায়েট আর শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ওজন কমার আশঙ্কা অনেক কমে যায়। সেই ক্ষেত্রে বেরিয়াট্রিক সার্জারি করতে হবে। চল্লিশের ওপরে যদি বিএমআই থাকে, ডায়েট আর শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ওজন কমানোর আশঙ্কা খুব কম।
প্রশ্ন : চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটু বলুন।urgentPhoto
উত্তর : স্থূলতাটাকে আমরা এখন রোগের মতো ধরি। টিউবারকুলোসিস, ম্যালেরিয়া, স্থূলতা এগুলো রোগ। অপুষ্টি কিন্তু রোগ নয়। তাই মাথায় আগে আসতে হবে ওজনাধিক্য একটি রোগ। আগে যদি ওজনাধিক্যকে রোগের মতো ধরি, তাহলেই তার চিকিৎসা নিয়ে ভাবব। এর চিকিৎসার জন্য একটি পদ্ধতি করা আছে। চিকিৎসার মধ্যে প্রথম হলো ডায়েট আর শারীরিক পরিশ্রম। যেকোনো পর্যায়েরই ওজনাধিক্য হোক সেটাকে নিয়ে আসতে হবে। ক্লাস ওয়ানে সব সময় এটা চেষ্টা করতে হবে।
যখন বিএমআই পয়ত্রিশের ওপরে আছে, সেই সব রোগীর ক্ষেত্রে অনেক রোগ থাকতে পারে। যেমন ডায়াবেটিস। হার্টের রোগ, হাঁটু ব্যথা, নাক ডাকা। নাক ডাকা সাংঘাতিক সমস্যা। এরপর কিছু কিছু ক্যানসার হয় ওজনাধিক্যের জন্য। হার্নিয়া হয়, গল ব্লাডারে পাথর হয়। বন্ধ্যত্বের সমস্যা হয়। এসব সমস্যাগুলো স্থূলতার জন্য হতে পারে। ৩৫ বিএমআইয়ের ওপরে গেলে রোগগুলো অনেক বেড়ে যায়। এই রোগগুলো থাকলে এই স্থূলতাকে দ্রুত চিকিৎসা করতে চাই। তার মানে বেরিয়াট্রিক সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করতে চাই। যদি কারো বিএমআই চল্লিশের ওপরে থাকে, আর এই রোগগুলো নেই। আমরা তাও ধরে নিই এই রোগগুলো ধরবে। যেহেতু এটা ডায়েট বা জীবনযাপনের পরিবর্তনে যাবে না। সেই জন্য আমরা সেখানে বেরিয়াট্রিক সার্জারি বলি। আগে আমাদের ভাগ করতে হবে কোথায় করব, কোথায় করব না। এর মধ্যে আবার অনেক রকম বিষয় আছে বয়স কত, রোগীর কোনো মানসিক সমস্যা আছে কি না, তার প্রতিজ্ঞা নিজের প্রতি কেমন, কোনো ওষুধ খাচ্ছে কি না, যার জন্য স্থূলতা হচ্ছে। নেশাগুলোকে দেখতে হবে। এসব দেখে, চিন্তাভাবনা করে এরপর দেখে যদি ঠিক আছে, আর যদি রোগী প্রতিজ্ঞা করে যে এই কাজগুলো করব তাহলে আমরা সার্জারি করি।
প্রশ্ন : বেরিয়াট্রিক সার্জারি বিষয়টি কী?
উত্তর : স্থূলতার চিকিৎসা করতে গেলে পাকস্থলী আর খাদ্যনালিতে অস্ত্রোপচার করি। কীভাবে করি? ফুটো করে করি। অর্থাৎ ল্যাপারেস্কোপিক সার্জারির মাধ্যমে। যেহেতু এটা ল্যাপারেস্কোপিক সার্জারি, তাই এর জন্য খুব ব্যথা হয় না। সেলাই কাটার কোনো ব্যাপার থাকে না। ছোট ছোট দাগ থাকে, যেটা পরে বোঝা যায় না এবং কোনো রক্তপাত হয় না।
এই অস্ত্রোপচারের সময় আমরা পেটের মধ্যে গিয়ে পাকস্থলী যে আয়তনের আছে এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশ ব্যবহার করতে দেব। এর মানে রোগী ওইটুকুই খেতে পারবে। আর অতটা খেয়ে তৃপ্ত হয়ে যাবে। খাদ্যনালিতে এক-তৃতীয়াংশ বাইপাস করে দিই যে সেখানে খাবার যাবে না। এতে আমি কম খেয়ে তৃপ্ত হয়ে গেলাম। আর আমার পুরো খাবারটা শোষণ হলো না। এতে আস্তে আস্তে শরীরে চর্বি কমে যাবে।
দেখা যাবে, এক বছরে ওজন কমে যাচ্ছে। কারো হয়তো ১৫০ কিলো ছিল, তার হতে হবে ৭০ কিলো, তার হয়তো ৯০ কিলো হবে। সার্জারি কিন্তু আদর্শ ওজন পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারবে না। তার থেকে একটু ওপর পর্যন্ত রেখে দেবে। সেখান থেকে রোগীর নিজে চেষ্টা করে ওজন কমাতে হবে।
প্রশ্ন : এই সার্জারির পরে কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয় রয়েছে?
উত্তর : অস্ত্রোপচার হলো এই আয়োজনের একটি ছোট অংশ। লোকজন ভাবে অস্ত্রোপচারটাই বড় বিষয়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচলিত ল্যাপারেস্কোপিক সার্জারি হলো বেরিয়াট্রিক সার্জারি। এখানে নিরাপত্তা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর পুষ্টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি রোগী অস্ত্রোপচার করার পর ভাবে যে আমাকে কিছু করতে হবে না, সে ভুল ভাবছে। এরপর পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
অস্ত্রোপচারের পর আমরা একটি প্রধান মত দিয়ে দিলাম যে ভাত, রুটি, মিষ্টি এড়িয়ে যাবেন। বন্ধ নয়, এড়িয়ে যাবেন। এটা কার্বোহাইড্রেট। এগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। ছোট পেট থাকলে আমাকে ভেবে ভেবে ভালো খাবার দিতে হবে। রোগীর খাদ্য পছন্দের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের আগে থেকে এর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আমার কাছে অনেক কিছু আছে, তবে আমি বেছে বেছে খাব।
অস্ত্রোপচারের পর যেহেতু খাবারটা কম থাকে, আমরা একটা ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দিয়ে থাকি। আর বছরে একবার অন্তত একটা পরীক্ষা করাতে হবে, শরীরে প্রোটিন, ভিটামিন সব ঠিকঠাক আছে। এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : এখানে ব্যায়ামের কি কোনো ভূমিকা আছে?
উত্তর : ব্যায়ামের বড় ভূমিকা আছে। আমাদের এশিয়ায় নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। নারীরা অনেক বেশি অস্ত্রোপচার করায়। ৭৫ ভাগ রোগী নারীই থাকে। আমাদের দেশে কিন্তু নারীরা জিমে যায় না। অনেক সময় এসব রোগীর হাঁটু ভালো থাকে না। আমরা ব্যায়াম করাতে পারি না। এদের শ্বাসের সমস্যা থাকে। বেশি শারীরিক পরিশ্রম দিতে পারি না। হার্টের জোর কম থাকে। তাই একটু অপেক্ষা করে, তখন আমরা বলি, এতদিন তো পরিশ্রম করেননি, এবার সেগুলো করুন। পরিশ্রম না করলে যে ওজন কমবে না, সেটি নয়, ওজন কমবে। শারীরিক পরিশ্রম যদি সে করে তাহলে খুব ভালো থাকবে। যে রোগীটা দেড়শ কিলো নিয়ে আমার কাছে আসছে আমার দায়িত্ব তাকে পুষ্টির শিক্ষা দেওয়া। তাকে তার অনুযায়ী শারীরিক ব্যায়াম দিতে হবে। এভাবে করলে আমরা দেখছি রোগীর অনেক লাভ হচ্ছে।