বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় ল্যাপারোস্কোপি
ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করা যায়।এই বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩৬৭তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. শারমিন আব্বাসী। বর্তমানে তিনি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় ল্যাপারোস্কোপির ভূমিকা কতটুকু?
উত্তর : আসলে আমাদের আগে জানতে হবে বন্ধ্যাত্ব বলতে আমরা কী বুঝি? স্বাভাবিকভাবে যেটা চিন্তা করা হয়, এক বছর ধরে কোনো দম্পতি সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের কোনো সমস্যা নেই, এরপরও যদি স্ত্রীর গর্ভধারণ না হয়, একে আমরা সাধারণত বন্ধ্যাত্ব বলছি। বন্ধ্যাত্ব আমরা যখন নির্ণয় করি, তার একটি পর্যায়ে গিয়ে আমাদের সাধারণত ল্যাপারোস্কোপিটা লাগে। এখন কখন ল্যাপারোস্কোপি করব এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখা গেল, একজন রোগী আমাদের কাছে আসল কিন্তু তার সম্পূর্ণ ইতিহাস আমার কাছে নেই। আমরা সাধারণত বন্ধ্যাত্বের জন্য যেটা করি, অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে সেটা করা হয় না। নারী ও পুরুষ আলাদা করে আমরা ইতিহাস নেই। নারীর কোনো সমস্যা আছে কি না, কী অবস্থা সেটা জানতে চাই। পুরুষ যে তার ইতিহাসটাও সম্পূর্ণ নিই। দাম্পত্য জীবনে সে কোনো সমস্যা বোধ করছে কি না বা তাদের কোনো রোগ আছে কি না। সম্পূর্ণ ইতিহাসটা পর্যবেক্ষণ করে দেখি যে তার কোথায় ঝামেলা আছে। বন্ধ্যাত্বের কারণ পাওয়ার পর ওই কারণ অনুযায়ী আমরা চিকিৎসা শুরু করি। কারণ পাওয়া না গেলে আমরা কী করব? সেই ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এক বছর তারা সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেছে, তারপর হয়তো ছয় মাস ডিম্বাণু তৈরির ওষুধও খেয়েছে, বাচ্চা নেওয়ার জন্য। এরপরও তার গর্ভধারণ হয়নি। তখন আমরা ডায়াগনস্টিক ল্যাপারোস্কোপি করে ফেলি। যখন আপনি ডায়াগনোসিস ল্যাপারোস্কোপি করে ফেললেন, এটি করলে মনে হবে যে আর কোনো ল্যাপারোস্কোপি কি হতে পারে? হ্যাঁ, সেটা হতে পারে। এটা হচ্ছে থেরাপিউটিক অথবা প্রোসিডিউর ইনডিকেটিভ। এর মানে একটি ডায়াগনোস্টিক ল্যাপারোস্কোপি করে আপনি ঢুকলেন ভেতরে, ঢুকে দেখি টিউবের কী অবস্থা বা ওভারির কী অবস্থা। দেখি ওভারির কার্যক্রম ঠিকঠাকমতো আছে কি না। যদি থাকে, তাহলে ভালো। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার একটি বড় বিষয় হলো তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। ডাক্তার যা বলবে সেই অনুযায়ী চলতে হবে।
আর আপনি হয়তো কোনো সিস্ট পেলেন, বন্ধ্যাত্বের একটি বড় অংশজুড়ে আছে, এন্ড্রোমেট্রিওসিস বা চকোলেট সিস্ট। চকোলেট সিস্ট মানে ভেতরে চকোলেট তা নয়, সেই ধরনের একটি জিনিস ভেতরে থাকবে এবং এই কারণে রোগীর অনেক ব্যথা হয়। সে ঋতুস্রাবের সময় বা সহবাসের সময় অনেক ব্যথা অনুভব করে। অথবা নিয়মিত একটা ব্যথা তার সব সময় থাকে। সিস্ট যদি থাকে সেই ক্ষেত্রে আমরা সিস্টেকটোমি করে দিচ্ছি। আর ইউট্রাস বা অন্য যেকোনো জায়গায় যদি এ রকম থাকে, তাহলে আমরা হয়তো একে পুড়িয়ে দিচ্ছি। আমরা একে বলি ভালগারেশন অথবা এবলেশন- এই রকম কিছু। অনেক সময় দেখা যায় টিউবটা আছে, ওভারিটা আছে- এমনভাবে তারা পেঁচিয়ে আছে যে সমস্যা করছে। যেটা স্বাভাবিক গর্ভাবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করবে। সেই ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা জিনিসটা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে বিষয়টি ঠিক করি। এভাবেই সাধারণত চেষ্টা করা হচ্ছে, ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে বন্ধ্যাত্বকে যত বেশি কমিয়ে আনা যায়।urgentPhoto
প্রশ্ন : ব্ন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপির সাফল্যের হার কতখানি?
উত্তর : এই বিষয়ে আসলে নির্ভর করবে আপনি ভেতরে গিয়ে কী পাচ্ছেন। আপনি হয়তো ভেতরে গেলেন কিছুই পেলেন না। তার টিউব ভালো, ওভারি ভালো, আপনি পরামর্শ করলেন, হয়তো ডিম্বাণু বাড়ার জন্য ওষুধ দিলেন, দুই/তিন মাস পর ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সফল হলেন।আপনি চকোলেট সিস্ট পেলেন। একে কেটে বের করে দিলেন, যেই যেই জায়গায় সমস্যা ঠিক করে দিলেন। সেই ক্ষেত্রেও সম্ভাবনা বেশি। এখন যাদের ধরেন অনেক দিন ধরে সংক্রমণ, একদম টিউব বন্ধ হয়ে আছে, আমরা সাধারণত ডাই দিয়ে পরীক্ষা করি, নীল রঙের একটি ডাই দিয়ে আমরা দেখি জিনিসটি ঠিকঠাকমতো যাচ্ছে কি না।
এখন হয়তো টিউব দুটোই বন্ধ। তাহলে আপনার গর্ভাবস্থা হবে কোথা দিয়ে? আপনি তো করে দিলেন, ল্যাপারোস্কোপি করে মূল্যায়ন করলেন, কোথায় কী সমস্যা আছে। কিন্তু তখন সাধারণত রোগীটাকে ছেড়ে দিলে তার গর্ভবতী হওয়ার আশঙ্কা একদম কম। সেই ক্ষেত্রে তাকে পরামর্শ দিতে হবে। বলতে হবে, মা তোমার দুটো টিউবই যেহেতু বন্ধ, স্বাভাবিক ভাবে তো তোমার সন্তান হবে না। সেই ক্ষেত্রে আইভিএফের ভূমিকা অনেক বেড়ে যায়। তখন টেস্ট টিউব বেবি করতে হবে।
প্রশ্ন : বর্তমানে বাংলাদেশে ল্যাপারোস্কোপি কতখানি হচ্ছে?
উত্তর : আগে তো শুধু শহরের অংশগুলোর ক্ষেত্রে হতো। এখন কিন্তু এটা একদম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এবং চেষ্টা করা হচ্ছে, এই সেবাটা সবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আমাদের দেশেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। আমাদের অনেক গাইনোকোলোজিক্যাল ফেলোরা যাচ্ছেন, বিদেশে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার জন্য। আগের থেকে এর অস্ত্রোপচারের হার আর সুবিধাটা বাংলাদেশে অনেক বেশি বেড়ে গেছে এবং হচ্ছে। তার ফলাফলও আমরা ভালো পাচ্ছি।
প্রশ্ন : সরকারিভাবে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে?
উত্তর : সরকারিভাবে তো অবশ্যই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন মোটামুটি প্রতিটা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ল্যাপারোস্কোপি মেশিন রয়েছে। সেখানে প্রতিনিয়ত সরকার এই বিষয়ে বিশেষ নজর দিচ্ছে এবং চেষ্টা করছে এই যন্ত্রের পরিব্যাপ্তি বাড়াতে এবং এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ রয়েছে এমন চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে।
প্রশ্ন : এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে খরচের বিষয়টি কেমন?
উত্তর : খরচের বিষয়টি আসলে নির্ভর করছে, আপনি কীভাবে রোগীকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন তার ওপর। সাধারণত ল্যাপারোস্কোপি মেশিনের একটি নিজস্ব খরচ রয়েছে। সেই খরচটা তো থাকবেই। তবে যদি সে সরকারি মেডিকেলে করে তাহলে তো কোনো খরচই নেই। বেসরকারি মেডিকেলে এলে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে খরচ হবে। এটা মোটামুটি সাধ্যের মধ্যেই রয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা, এ ধরনের ইউট্রাসে টিউমার, ল্যাপারোস্কোপি করে ঠিক করে দিলে রোগী একদিন পর বাসায় চলে যেতে পারে। হাসপাতালে থাকার বিষয়টি কম। সাধারণ অস্ত্রোপচার করলে সাত থেকে ১০ দিন হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। তারপর হয়তো আমরা ব্যান্ডেজটা খুললাম, রোগী বাসায় গেল। কিন্তু ল্যাপারোস্কোপির পর আপনি ছয় থেকে আট ঘণ্টা পর বাড়ি চলে যাচ্ছেন। অথবা বেশি হলে হয়তো একদিন হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে।
দ্বিতীয় কথা হলো, আপনি কাজে কখন যাবেন? আপনার যদি পেট কেটে আমি অস্ত্রোপচার করি, বলব যে দেড় মাস পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে, ভারি কাজ করা যাবে না। ল্যাপারোস্কোপির পর রোগী বাড়ি চলে যাচ্ছে, অফিসে যাচ্ছে, কাজ করছে। তাই আপনার কাজের পরিধিটা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এখানে কাটা কম লাগছে, রক্তপাত কম হচ্ছে। যদি আপনি মূল্যায়ন করার জন্য বলেন, এটি খুব স্মার্ট ব্যবস্থা।