স্বরভঙ্গের কারণ ও করণীয়
স্বরভঙ্গ হওয়া বা গলার স্বর ভেঙে যাওয়া বেশ প্রচলিত সমস্যা। এর চিকিৎসা সঠিকভাবে না হলে বিভিন্ন জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
স্বরভঙ্গের বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৯৬৫তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. ফুয়াদ মোহাম্মদ শহীদ হোসেন। বর্তমানে তিনি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইএনটি ও হেড-নেক সার্জারি বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : স্বরভঙ্গ হওয়া বা গলা ভেঙে যাওয়া কী কী কারণে হতে পারে?
উত্তর : স্বর, অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার অনন্য উপহার। আমি বলব, এটি হলো যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। খুব সামান্য কারণ থেকে অনেক বড় কারণেও স্বরভঙ্গ হতে পারে। দেখা গেল, ঠান্ডা লেগেছে, গলার স্বর বসে যাচ্ছে, হঠাৎ করে হয়তো আর কোনো কথাই বের হচ্ছে না—এটি স্বরভঙ্গের খুব সাধারণ একটি ঘটনা। এটি আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কখনো না কখনো হয়ে থাকে। একে আমরা বলি একিউট ল্যারিংজাইটিস। অর্থাৎ আমাদের ভোকাল কর্ড, মানে যেখানে কথা উৎপন্ন হয়, সেখানে প্রদাহজনিত কারণে, তার কাজ সে ঠিকমতো করতে পারে না। এটি সাময়িকভাবে তার কাজকে বন্ধ করে দেয়। এতে দেখা যায় কথা বের হচ্ছে না। এখানে চিকিৎসাও খুব সামান্য। বিশ্রামটিই হলো সবচেয়ে বড় চিকিৎসা।
আমাদের দেশে যদি কাজটি করতে বলা হয়, তাহলে রোগী প্রথমে বলবে, ‘আমাকে চিকিৎসক কথা বলতে না করেছে।’ এই যে কথাটা বলা হলো, এতেও কিন্তু তার ক্ষতি করা হলো। অনেক বইয়ে বলা রয়েছে, যদি শ্বাসপ্রশ্বাসও বন্ধ রাখা যেত, তাহলে ভালো হতো। কারণ, যখন আমরা শ্বাস নেই, তখনো ভোকাল কর্ড নড়ে। কখনো কিন্তু তার বিশ্রাম হচ্ছে না। এরপরও যদি বেশি কথা বলা হয়, তখন কিন্তু তার বিশ্রাম হচ্ছে না। অনেকে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে। আমাদের দেশে যদি এমন করা হয়, তাহলে হয়তো ছোটখাটো একটি মেলা হয়ে যাবে। এটি স্বরভঙ্গে একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
আরেকটি হলো ক্রনিক ল্যারিংজাইটিস। যারা কণ্ঠ বেঁচে খায়, এটা ফেরিওয়ালা হতে পারে, একদম রাজনীতিবিদ পর্যন্ত হতে পারে, গায়ক, স্কুলের শিক্ষক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, চিকিৎসক, আইনজীবী এদের এ ধরনের সমস্যা হয়। আরেকটি হলো, যে মায়ের পিঠাপিঠি সন্তান রয়েছে, যারা প্রত্যেকে খুব দুষ্ট—সেসব মায়ের অনেক বেশি কথা বলতে হয়। তাদের সমস্যা হয়। এসব ব্যক্তির স্বরের বিশ্রাম হয় না বললেই চলে। এরা যদি ঠিকভাবে কথা ব্যবহার না করে, তাদের কণ্ঠ কিন্তু বসে যেতে থাকে। দেখা যায়, তাদের বার বার স্বরভঙ্গ হতে থাকে। কিছুদিন পরপরই এরকম হয়। সে যদি সচেতন না হয় ভোকাল কর্ডে ছোট ছোট নডিউলের মতো হয়। তখন এই স্বরভঙ্গ স্থায়ী সমস্যায় পড়ে যায়। তবে এখানে একটি বিষয় হলো, এতে ম্যালিগনেন্ট বা ক্যানসারের ঝুঁকি নেই। তবে বিরক্তিকর অবস্থা হয়। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়। যে গান গায়, সে নিজে একটি বিব্রতকর অবস্থায় থাকবে। তবে এটি জীবনহানীকর কোনো কিছু নয়। আরেকটি হলো অনেক সময় ভোকাল কর্ডে পলিপ হতে পারে। এটিও আমরা পাই। আরেকটি হলো অনেক সময় ভাইরাল কিছু জিনিস দিয়ে প্যাপিলোমা হয়। এটি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। এগুলো প্রত্যেকটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
আরেকটি বিষয় বলি, আমরা একটু দেরিতে খাই। এভাবেই আমরা অভ্যস্ত। আমরা খেয়েই হয় টিভি দেখি, অথবা শুয়ে গল্প করি । এই যে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়া, এটি স্বরভঙ্গের ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখে। শুধু তাই নয়, কণ্ঠনালির ক্যানসারের ক্ষেত্রেও এর পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। এসিড রিফ্লাক্স কিন্তু ভয়েজের গুণগত মানকে পরিবর্তন করে দেয়। এ জন্য আমরা বলি রাতের খাবারের দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর শুতে যাবেন। সে হয়তো ঘুমাল না, তবে শুয়ে শুয়ে অন্য কাজ করছে, এতেও তার এসিড রিফ্লাক্স হচ্ছে। ক্রনিক ল্যারিংজাইটিসের ক্ষেত্রে এটি একটি সমস্যা। আরেকটি হলো স্বরের সঠিক ব্যবহার তাকে শিখতে হবে।
সবচেয়ে যেটি খারাপ, যেটি নিয়ে আমরা সবচেয়ে ভয় পাই, সেটি হলো কণ্ঠনালির ক্যানসার। এটি আমাদের দেশে ক্রমেই বাড়ছে। আপনি জানবেন হেডনেক ক্যানসারের প্রবণতা আমাদের দেশে দিনকে দিন বাড়ছে। ভোকাল কর্ডের ক্যানসার এখন অনেক।
তাই এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমি বিনিতভাবে অনুরোধ করব, কারো যদি স্বরভঙ্গ বেশিদিন ধরে থাকে, দুই/তিন সপ্তাহ হচ্ছে, তাহলে অবশ্যই আপনি চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয় অবশ্যই লক্ষণীয়। সেই ব্যক্তি ধূমপায়ী কি না, সেই ব্যক্তির অ্যালকোহল পানের অভ্যাস রয়েছে কি না, সে কোনো রঙের কারখানায় কাজ করে কি না, অথবা তার পরিবারের এর কোনো ইতিহাস আছে কি না। অনেক সময় আমরা এই রোগীগুলোকে অনেক পরে পাই।
পরে কখন রোগীগুলো আসে জানেন? যখন স্বরভঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। শ্বাসকষ্ট যখন হয়, অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এই স্বরভঙ্গ হয়তো ছোট একটি বৃদ্ধি ছিল, শ্বাস-প্রশ্বাসের রাস্তা হয়তো তখন ব্লক করেনি। তখন আসলেন না। উনি কখন আসলেন, যখন শ্বাসনালির রাস্তাটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। যখন হয়তো কেউ বসে থেকেই বুঝতে পারছে, তার শব্দ হচ্ছে একটা। একে আমাদের ভাষায় বলি স্ট্রায়ডল। তখন হয়তো তিনি দেখছেন, অল্পতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। শুতে পারছে না। শুলে হয়তো মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে যাবে। যখন তারা চিকিৎসকের কাছে যায়, তখন কোনো কাজ হয় না। এটা আমাদের দেশে হচ্ছে। আরো দুঃখজনক হলো, অনেক অশিক্ষিত লোক থেকে শুরু করে অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষও অবহেলা করছে। এই শিক্ষাটা তার কোনো কাজেই আসে না।
শ্বাসনালির ক্যানসারে অনেকগুলো বিষয় রয়েছে চিকিৎসার। এর মধ্যে বাইপাস করে দেওয়া কিন্তু সবচেয়ে ভালো। যখনই তার, শ্বাসনালিতে ক্যানসার হবে বা ভোকাল কর্ডে ক্যানসার হবে, যেকোনো সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে রোগী মারা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে গলায় ফুটো করে একটি বিকল্প রাস্তা করে দিই, যাতে রোগী বেঁচে থাকতে পারে। তবে অনেক রোগীকে এটি বললে, তার আত্মীয়স্বজন এটি মেনে নিতে চায় না। অথচ তার প্রিয় মানুষটি এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না যাওয়ার কারণে আরো আগেই মরে যাচ্ছে। আমরা এমন রোগী দেখেছি যে ১২/১৩ বছর বেঁচে রয়েছে, ঠিকমতো যার অস্ত্রোপচার হয়েছে। চাইলে ভয়েস রিহেবিলেশনের পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।