নেপালের অভিজ্ঞতা
সব বিল্ডিং ধসে পড়ছিল : কল্যাণ
আসছে ঈদ উপলক্ষে তিনটি নাটকের শুটিংয়ের জন্য ২০ এপ্রিল নেপালে যান অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয়, পরিচালক যুবরাজ খান, অভিনেতা কল্যাণ কোরাইয়া, রুনা খান, নোমিরা, শাহাদাত হোসেনসহ ইউনিটের কলাকুশলীরা। নেপালের নাগারকোটে ২৫ এপ্রিল যুবরাজ খান পরিচালিত ‘হেনা’ নাটকের শুটিং করছিলেন কল্যাণ ও নোমিরা। নাটকের শুটিংয়ের মাঝে ভূমিকম্পের কবলে পড়েন তাঁরা।
এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভেতর কল্যাণদের নাটকের দল কী করে নেপালে ২৪ ঘণ্টা পার করেছেন এই বিষয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
কল্যাণের অভিজ্ঞতা
আমি ও নোমিরা নাটকের সংলাপ বলছিলাম। যখন ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তখন নোমিরার ক্লোজশট ছিল। ও সংলাপ বলতে মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ছিন্নবিছিন্ন হয়ে গেল। কাপড় যেভাবে আছাড় দিয়ে ধোঁয়া হয়। সেভাবে আছাড় খেয়ে সবকিছু ভেঙে পড়ছিল। তখন আমরা স্পটে ছিলাম পাঁচজন। আমি, নোমিরা, যুবরাজ ভাই, শাহাদাত ভাই ও আরমান। আমরা যেখানে শুটিংয়ের ক্যাম্প বানিয়েছিলাম, সেখানে ছিলেন জয় ভাই। জয় ভাই একটু অসুস্থ ছিলেন। আর রুনা আপা তখন ছিলেন ওয়াশরুমে। ভূমিকম্পের সময় সেই ওয়াশরুম রুনা আপার চোখের সামনেই ভেঙে পড়ে। আর জয় ভাই যে উঁচু টিলার ওপর ছিল সেই টিলাটি দেবে গিয়েছিল।
ভূমিকম্পের পর জয় ভাই এমন দৌড় দিয়েছিল, সে নিজেও জানে না কোথায় দৌড়ে সে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা প্রথমে স্পট থেকে নড়াচড়া করতে পারিনি। সেখানে লোহার চেয়ার-টেবিল ছিল। সেগুলো শক্ত করে ধরে রাখি। চোখের সামনে দেখতে থাকি বিল্ডিং ধসে পড়েছে। রিসোর্ট, গার্ডেন, লোহার বড় বড় গেটগুলো একটু একটু পর ভেঙে পড়ছে।
আমরা উপায় না পেয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় যাই। যাওয়ার একটু পর দেখি আমরা যেখানে শুটিং করছিলাম সেই পাহাড় ভেঙে পড়ল। একটু পরপর তখনো ভূমিকম্প চলছিল।
আস্তে আস্তে আমরা পাহাড়ের নিচে রাস্তায় নেমে আসি। পাঁচ মিনিট পরপর ভূমিকম্প হচ্ছে। গাড়িতে করে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। রাস্তায় পাথর ও গাছ ভেঙে পড়ে আছে।
আমাদের সামনে যে সুন্দর বাজারটা ছিল, সেটাও ধ্বংস হয়ে গেল। দেখে বোঝার উপায় নেই এটা এত সুন্দর বাজার ছিল। মানুষজন ছুটছে যে যারমতো। তখন শুনলাম আমাদের থেকে এক কিলোমিটার দূরে পুরো এলাকা দেবে গেছে।
শোনার পর সবার মধ্যে একধরনের ভয় কাজ করতে শুরু করল। সবাই যে যারমতো করে আল্লাহকে ডাকছিল। সব জায়গায় খাড়া পাহাড়। কোথায় আমরা থাকব সেটা খুঁজে বের করতে পারছিলাম না। সেই মুহূর্তে রুনা আপা আর জয় ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমরা সবাই মিলে একটা পাহাড়ের ওপর যাই। তখনো আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি সেখানে দাঁড়াব কি না। কিছুক্ষণ পর রুনা আপা পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে যায়। পড়ার পর হাঁটুতে এবং ডান হাতে প্রচণ্ড চোট পায় সে। রক্ত বেরুতে থাকে। তারপর সবাই ওখানেই আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।
পুরো দেশের অবস্থা একই। কিছুক্ষণ পর কিছু পযর্টকসহ আমরা সাত-আটটা গাড়ি খুঁজে পাই। তখন মনে হলো যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমরা মনে হয় দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছি। এক ঘণ্টার রাস্তা। কিন্তু আমরা দু-তিন ঘণ্টা পর শহরে পৌঁছাই। শহরের প্রায় সবকিছুই ছিল বিধ্বস্ত। ল্যাম্পপোস্টগুলো ভেঙে পড়ে আছে। তখন মাথায় কিছুই কাজ করছিল না। রুনা আপাকে নিয়ে আমরা হাসপাতালে যাই। হাসাপাতালেও কোনো জায়গা নেই। বিদ্যুৎ নেই। ইমার্জেন্সি বলে আর কিছু নেই। সব জায়গায় আহত মানুষজন। কোনো কেবিন ফাঁকা নেই। রুনা আপাকে ওই অবস্থায় আমরা ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার এক্স-রে করতে বলল। কিন্তু এক্সরে করার কোনো জায়গা আমরা খুঁজে পাইনি।
রুনা আপাকে স্যালাইন আর ইনজেকশন দিয়ে প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট করা হলো। যেহেতু বিদ্যুৎ নেই, সবার মোবাইলে চার্জও শেষের দিকে। তখন সবাই একটা মোবাইল খোলা রেখে সবগুলো বন্ধ করে দিই। আমি মোবাইলে প্রথমে ওয়াই-ফাই দিয়ে ইন্টারনেটে ঢোকার চেষ্টা করি।
কিন্তু কোথাও ওয়াই-ফাই নেই। মোবাইলে ক্রেডিট ঢোকাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু সব দোকানপাট বন্ধ। সবাই রাস্তায়। একটা ভয়ংকর অবস্থা। বলে বোঝানো যাবে না।
তখন কীভাবে আমরা দেশে ফিরব এটা বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের সব এখানেই শেষ কি না, তাই ভাবছি আবার সেই সাথে এটাও ভাবছি আমাদের টিকিট কই বা কী করে দেশে ফিরব?
হোটেলে কীভাবে ফিরে আসব তাও জানি না। কারণ একটু পরপর ভূমিকম্প হচ্ছিল। আমরা অনেকগুলো হোটেলে ছিলাম। শেষে যে হোটেলে উঠেছি, সেটার নাম ছিল ‘মুনলাইট’। তারপর আমরা হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। হোটেলে গিয়ে শুধু পাসপোর্ট আর টাকা-পয়সা নিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি।
কিছু খাব যে তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ। হোটেলে খাবারের কোনো অর্ডার নিচ্ছিল না। হোটেলও দেখার মতো আর নেই। সব গ্লাস ভেঙে গেছে। বিল্ডিয়ের মাঝে মাঝে ফাটল ধরেছে। সবাই ক্ষুধায় কাতর হয়ে আছে। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমরা অনেক কষ্টে একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করলাম। তারপর সবাই মিলে কিছু খেলাম। সেখানে ওয়াই-ফাই পাওয়ার পর আমি বাসায় ও ফেসবুকে আমাদের অবস্থানের কথা জানাতে পারি। কিছু মিডিয়ার সঙ্গে ফেসবুকে কথা হয়।
তারপর ওখান থেকে চলে আসার পর ওয়াইফাই আর পাইনি। কারো সঙ্গে যোগাযোগও করা সম্ভব হয়নি।
রাতে ফাইভ স্টার হোটেল রেডিসনে গেলাম থাকার জন্য। শুনেছি রেডিসন অনেক মজবুতভাবে বানানো। কিন্তু গিয়ে দেখি রেডিসনের বিল্ডিয়েও ফাটল ধরেছে। হোটেলের সব বিদেশিরা রাস্তায় নেমে এসেছে। কেউ হোটেলে নেই। হোটেলের বালিশ-তোশক সব ফ্লোরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই ওখানে শুয়ে পড়ল। রেডিসনের বুফে চালু ছিল। আমরা সবাই ডিনার খেয়ে নিলাম। তারপর নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা সেখান থেকে নেপালের দূতাবাসে যোগাযোগ করে। তারপর রেডিসন থেকে দূতাবাসের গাড়ি আমাদের নিয়ে আসে। এরপর দূতাবাসের খোলা বাগানে তাঁবু করে আমরা সবাই একসঙ্গে বসে থাকলাম। কারো চোখে ঘুম নেই। চোখে সবার আতঙ্ক। সবাইকে সান্ত্বনা দিলাম। কেউ যে ওয়াশরুমে যাবে তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক ঠান্ডা, অনেক শীত। এভাবে বসে থেকে আমাদের রাত পেরুল। শুধু মনে হচ্ছিল আমাদের বাঁচতে হবে। পরের দিন আমাদের টিকিট কনফার্ম ছিল।
কিন্তু সকালে বাংলাদেশ থেকে একটা প্লেন এসে ফেরত যায়। জ্যাম থাকার কারণে ল্যান্ড করতে পারেনি। বিকেল ৪টায় আর একটা প্লেন আসার কথা ছিল। কিন্তু সেটা দেরি করে ৬টায় আসে। ট্রাফিক থাকার কারণে আমরা প্লেনে উঠতে পারছিলাম না। আর এয়ারপোর্টের অবস্থা ছিল পুরো কমলাপুর রেলস্টেশনের মতো অথবা সদরঘাট। আমরা দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এয়ারপোর্টে ঢুকলাম। চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর বোর্ডিং নিলাম। তারপর ভেতরে কোনো চেকিং ও নিরাপত্তাবাহিনীর কেউ ছিল না। বাইরে তখনো কিছুক্ষণ পরপর ভূমিকম্প হচ্ছিল। সব বিদেশি রানওয়াতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এয়ারপোর্টের বাথরুমে কোনো পানি ছিল না। খাবার পানিও ছিল না। আমরা সবাই না খেয়ে ছিলাম।
বাস্তবতাটা খুব কঠিন ছিল। রাত কয়টায় আমাদের বিমান এলো জানি না। তখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। ঝুম বৃষ্টির কারণে আমরা রানওয়েতে থাকতে পারলাম না। সবাই প্লেনে উঠে গেলাম। তারা কোনো কলও দেয়নি। আমরা জোর করে উঠেছি। তারপরও দুই ঘণ্টা পর প্লেন ছাড়ল। প্লেন ছাড়ার পর মনে হলো মরে যাচ্ছি। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল। আধঘণ্টা ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম ভাঙার পর দেখি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। এরপর বিমানবন্দরে সবাই সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেই। এখন পর্যন্ত একটার পর একটা সাক্ষাৎকার দিয়েই যাচ্ছি।
ছেলের জন্য মায়ের দুশ্চিন্তা
কল্যাণের একটানা কথাগুলো শুনছিলেন তাঁর মা, বন্ধু অমিত ও অমিতের মা।
সবাই চুপচাপ। অভিনেতা কল্যাণের মা শান্তি অঞ্জলি কোরাইয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার ছেলের কিছু হলে তো আমি বাঁচতাম না। যখন বাংলাদেশে ভূমিকম্প হচ্ছিল, সবাই বাসা থেকে নিচে নেমে গেলেও আমি নামিনি। ও যখন কাল রাতে বাসায় ফিরল, ওর দিকে তাকাতে পারিনি। ঈশ্বরের কাছে শুধু প্রার্থনা করেছি।’
পরিবেশটা আবারও গুমোট হতে শুরু করল। সবাইকে হাল্কা করতে কল্যাণের বন্ধু অমিত হেসে বলে উঠলেন, ‘দোস্ত তুই কি শুধু নায়ক না মহানায়ক। এই অবস্থায় ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিয়েছিস? আচ্ছা তুই কি ছবিগুলো এডিট করে তারপর পোস্ট করেছিস?’
এই কথা শুনে কল্যাণ হেসে দিলেন। জানালেন, আমি প্রথমে ফেসবুকে কিছু না জানালে কেউ তো প্রথমে জানতই না আমাদের অবস্থানটা কি! আর ছবি তুলেছি এই ভেবে, আমরা যদি মরেও যেতাম পরে সবাই দেখতে পেত আমরা কীভাবে সেখানে ছিলাম। ঈশ্বর বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
বিদায় নেওয়ার সময় কল্যাণ ধন্যবাদ দিয়ে জানালেন, আপাতত নাটকের শুটিং থেকে দূরে থাকবেন তিনি।